ঝাড়খণ্ডের রাঁচির ১৫ কিলোমিটার দূরে রাতুচাটি গ্রামে জন্ম তার। শৈশবেই এই গ্রামে পাথরের টুকরো দিয়ে আম পাড়তেন। নিশানা ভেধে পারদর্শী ছিলেন। তীরন্দাজ হওয়ার স্বপ্নটাও উঁকি দিতে থাকে তার মনে। কিন্তু দীপিকা কুমারির স্বপ্নপূরণের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আর্থিক দুর্বলতা। অটোরিকশা চালক বাবা শিবনারায়ণ মাহাতো আর রাঁচি মেডিকেল কলেজের নার্স মা গীতা মাহাতোর পক্ষে মেয়ের স্বপ্নপূরণ করাটা যে অনেক কঠিন ছিল। আরচারির সরঞ্জামের অনেক দামি। সেটা বুঝেছিলেন দীপিকা নিজেও। তাই এক সময় বাঁশের তীর দিয়ে খেলেন তিনি। কিন্তু মেয়ের প্রতিভা এবং আরচারির প্রতি ভালোবাসা দেখে শত কষ্ট ভুলে গিয়ে দীপিকার লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে আসেন বাবা-মা। একসময় দীপিকার হাত ধরেই বদলে যায় অভাব-অনটনের সংসারটি। তীর-ধনুকেই বদলে দিয়েছে দীপিকার জীবনের গল্প। রাঁচির রাজা বলা হয় ভারতের ক্রিকেটার মহেন্দ্র সিং ধোনিকে। আর এই অঞ্চলের রানী হলেন ২৩ বছর বয়সী এ তরুণী। শুধু কি রাঁচির, আরচারিতে তিনি এখন ভারনের রানী।
উচ্চতায় ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি। ভারতীয়রা তাকে ডাকে কৃষষ্ণকলি নামে। ১৯৯৪ সালের ১৩ জুন রাঁচিতে জন্ম নেওয়া দীপিকা আরচারি ক্যারিয়ার শুরু করেন ২০০৫ সালে। বারো বছর আগে অর্জুন আরচারি একাডেমিতে ভর্তি হয়েছিলেন। এক বছর পর আন্তর্জাতিক আঙিনায় নাম লেখান তিনি। পালতোন হান্সদারের পর দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে ২০০৬ সালে মেক্সিকোর মেরিডায়ে অনুষ্ঠিত আরচারি বিশ্বকাপে জুনিয়র কম্পাউন্ড এককে স্বর্ণ জিতেছিলেন। তবে তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায় ২০০৮ সালে। কলকাতায় ট্রায়াল দিতে গিয়ে ওই বছরের জানুয়ারিতে জামশেদপুরের টাটা একাডেমিতে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখালে ভালো পারফরম্যান্স করেই সবার নজর কাড়েন। খুলে যায় বিশ্ব আরচারির দরজা। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত এগারতম বিশ্ব যুব আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে ১৫ বছর বয়সে প্রথম হয়েছিলেন দীপিকা। ওই আসরে রিকার্ব দলগত ইভেন্টেও সোনালি হাসি হেসেছিলেন।
শুরুর জীবনের কষ্টটা বদলে যায় ২০১০ সালে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত কমনওয়েল গেমস দিয়ে। রিকার্ব ব্যক্তিগত ও রিকার্ব দলগত দুটি ইভেন্টেই স্বর্ণ জিতেছিলেন রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়া দীপিকা। কমনওয়েলথ গেমসের পরই তাকে সবাই চিনতে পারে এবং ঘুরে যায় জীবনের গল্প। গতকাল সেই বদলে যাওয়া গল্পের কথাই শোনালেন দীপিকা, ‘কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জেতার পর আমার জীবনটা অনেক বদলে গেছে। আমার ক্যারিয়ারের প্রথম বড় সাফল্য ওটিই। টার্নিং পয়েন্ট বলা যেতে পারি। এরপর আর্থিক দিয়ে, পেশাদারি দিক দিয়ে আমার আরও সুযোগ বেড়েছে। পরিবারের কাছ থেকেও উৎসাহ পেয়েছি অনেক। আর ঐ সাফল্যেই প্রথম আমাকে লোকজন চিনেছে। ভারতে আরচারিটা আরও জনপ্রিয়ও হয়েছে তাতে।’ এ পর্যন্ত উঠে আসতে কোনো সমস্যা হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি, ‘পরিবার থেকে সাহায্য পেয়েছি। ছেলেমেয়ে বৈষম্যও ছিল না। তবে হ্যাঁ, শুরুতে ওখানে আরচারি শেখাটা কঠিন ছিল, কারণ সেই মানের কোচ ছিল না ওখানে, ভালো ইকুইপমেন্টও ছিল না। ধীরে ধীরে ক্যারিয়ারে আমি সব পেয়েছি।’
তিনটি ওয়ার্ল্ড আরচারি খেলেছেন। ২০১১ ইস্তাম্বুল, ২০১২ টোকিও ও ২০১৩ সালে সাংহাইয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে রৌপ্য জিতেছিলেন দীপিকা। ২০১১ তুরিনে এবং ২০১৫ কোপেনহেগেনে আরচারি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপেও সিলভার জিতেছিলেন তিনি। ২০১০ গুয়াংজুতে এশিয়ান গেমসে হয়েছিলেন তৃতীয়। ওই বছরই ঢাকায় অনুষ্ঠিত এস এ গেমসে খেলেছিলেন দীপিকা। দ্বিতীয়বারের মতো এসেছেন ঢাকায় এশিয়ান আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে। ২০১২ ও ২০১৬ অলিম্পিক খেলেছিলেন। সেখানে সেরাটা মেলে ধরতে পারেননি। তবে দীপিকার প্রধান লক্ষ্যই এখন ২০২০ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠেয় অলিম্পিকে, ‘এখানে আমি আমার নিজের সেরা পারফরম্যান দেখাতে চাই। আমার মূল টার্গেট ২০২০ অলিম্পিক।’
রাঁচিতে জন্ম। সেই শহরের ছেলে ভারতের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। তার সঙ্গে অনেকবারই দেখা হয়েছে দীপিকার। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন নয় যে, আমি ধোনির শহরে থাকি, আমি আমার শহরেই থাকি। এটা খুব ভালো লাগে যে আমরা দুজনই এক জায়গার। দেশের হয়ে খেলে ভালো কিছু করার চেষ্টা করছি।’ বাংলাদেশের আরচারি নিয়েও বলেছেন দীপিকা, ‘এই অঞ্চলের আরচাররা সরকারের সহযোগিতা পেলে, ভালো কোচিং পেলে অবশ্যই আরও ভালো করবে। তীরন্দাজদেরও সেই চেষ্টাটা থাকতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে তার জন্য। ভারত আরচারিতে ভালো করছে, কারণ আমরা পরিশ্রম করছি। ভারতে ৩-৪টি একাডেমি আছে, ওখান থেকে আরচাররা উঠে আসছে।’
ক্যারিয়ারের এতটা পর্যায়ে উঠে এসেছেন। সাফল্যের পুরস্কারও পেয়েছেন দীপিকা। ২০১২ সালে ক্রীড়াক্ষেত্রে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অ্যাওয়ার্ড অর্জুন পুরস্কার পেয়েছিলেন। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এফআইসিসিআই কতৃক বষৃসেরা ক্রীড়া ব্যক্তিত্বেও সম্মানে ভূষিত হন। একই সঙ্গে ২০১৬ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদশ্রী অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন। সেই দীপিকা এবার বাংলাদেশ জয় করতে চান।