রংমিস্ত্রি হিসেবে একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন শাহীন। মাসখানেক আগে তা তিনি ছেড়ে দেন।
তখনো পরকীয়া প্রেমে মত্ত আরজিনা-শাহীন। জামিলকে তালাক দিয়ে শাহীনকে বিয়ে করতে চান আরজিনা। প্রথমে রাজি হননি শাহীন। পরে রাজি হন। বিয়ের পর কীভাবে চলবে তাদের সংসার এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল দুজনের মধ্যে। তাদের চোখ পড়ে জামিলের টাকার প্রতি। ময়নার বাগের বিভিন্ন স্থানে সুদের ব্যবসা ছিল জামিলের। তাকে মেরে সেই টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা আসে তাদের মাথায়। বিয়ে করে কৌশলে জামিলের ওই সব টাকা তুলে নিজেরা অন্য কিছু করার চিন্তা করেছিলেন। রাজধানীর বাড্ডায় বাবা-মেয়ে খুনের ঘটনায় গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব জানান গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহমেদ। সংবাদ সম্মেলনে বাড্ডার জোড়া খুনে আরজিনা ও তার প্রেমিক শাহীন মল্লিককে গ্রেফতার দেখানো হয়। এ সময় ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান, এডিসি (মিডিয়া) ইউসুফ আলী, বাড্ডা জোনের এডিসি মানস কুমার পোদ্দার ও সিনিয়র এসি আশরাফুল কবির উপস্থিত ছিলেন। ডিসি মোস্তাক আহমেদ জানান, ডাকাতের হাতে স্বামী ও মেয়ে খুন হয়েছে এমন বিষয় প্রতিষ্ঠা করতে অভিনয় শুরু করেছিলেন আরজিনা। একই বাসায় থাকাবস্থায় আরজিনা ও শাহীনের ঘনিষ্ঠতা হয়। সংসারে স্বামী-স্ত্রীর বোঝাপড়া ঠিক না থাকায় আরজিনা স্বামীকে তালাক দিতে চেয়েছিলেন। বার বার তার থেকে দূরে সরে যেতে চেয়েছিলেন। এ জন্য শাহীনকে একটি উপায় বের করতে বলেন আরজিনা। ডিসি মোস্তাক বলেন, বাড্ডায় জোড়া খুনে মাসুমার ভূমিকা নিয়ে এখনো রহস্য আছে। তাকে নিয়ে তদন্ত অব্যাহত আছে। জিজ্ঞাসাবাদে মাসুমা জানান, খুনের পর তিনি ঘটনাটি জেনে যান। এরপর শাহীন তাকে সব জানান। বলেন, ‘যা হওয়ার তা হয়েছে, চলো পালিয়ে যাই। ’ মোস্তাক আহমেদ বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক ব্যক্তিরা এসব কথা বলেছেন। মামলার তদন্তের এখনো বাকি আছে। এর সঙ্গে আর কেউ জড়িত কি না তা খতিয়ে দেখা হবে। আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল কি না খতিয়ে দেখা হবে তাও। বৃহস্পতিবার উত্তর বাড্ডার ময়নার বাগের ৩০৬ নম্বর বাসায় জামিল শেখ ও তার ৯ বছরের মেয়ে নুসরাত জাহান খুন হন। ঘটনাটি জানাজানি হলে প্রতিবেশীদের কাছে আরজিনা দাবি করেন, তিন-চারজন ডাকাত তার ঘরে ডাকাতি করে স্বামী-সন্তানকে হত্যা করে পালিয়েছে। এমনকি তাকে ধর্ষণও করেছে। এ ঘটনায় বাড্ডা থানায় আরজিনা ও শাহীনকে আসামি করে মামলা করেন নিহত জামিল শেখের ভাই শামীম শেখ।
কাকুতি-মিনতি করেও ঘাতকদের মন গলাতে পারেনি শিশু নুসরাত : ‘আংকেল, আমার আব্বুকে মারছেন কেন? কী করেছে আব্বু?’ শাহীনকে এমন প্রশ্ন করেই বিছানায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত বাবার নিথর দেহ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে ফুটফুটে শিশু নুসরাত। সেখান থেকে টেনে-হিঁচড়ে তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে যান মা আরজিনা। অনবরত কান্নায় কাকুতি-মিনতি করেও সে মন গলাতে পারেনি ঘাতকদের। বাবাকে রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা করেছে নুসরাত একা। উল্টো বাবার সঙ্গে হারাতে হয়েছে নিজের প্রাণ। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বাড্ডায় খুন হন জামিল শেখ ও তার ৯ বছরের মেয়ে নুসরাত। পুলিশ জানিয়েছে, জামিলের খুনের ঘটনাটি দেখে ফেলেছিল নুসরাত। খুনের একমাত্র সাক্ষী এটাই তার অপরাধ, যে কারণে মা ও তার প্রেমিক তাকে চিরতরে বিদায় করে দেন দুনিয়া থেকে। বাবাকে বাঁচাতে অনেক আকুতি ছিল তার। মায়াকান্নাতেও মন গলেনি ঘাতকদের। বাবা-মা ছাড়াও স্বজনদের কাছে খুব আদরের ছিল শিশু নুসরাত জাহান। অত্যন্ত বাবাভক্ত ছিল সে। কোথাও যেত না বাবা জামিল শেখকে ছাড়া। পড়াশোনায় আগ্রহ ছিল ভালো। পড়ত বাড্ডা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে। চঞ্চল, সুন্দর-সুদর্শন, মায়াবী নুসরাত চাচা-চাচিদের মধ্যমণিতে পরিণত হয়। প্রায় ছয় মাস আগের কথা, যখন বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাবেন নুসরাতের মা আরজিনা। চাকরিতে ছুটি না থাকায় যাবেন না বাবা জামিল শেখ।
আরজিনা তাকে নিয়ে যেতে চাইলে নুসরাত মাকে বলে, ‘আব্বুকে ছাড়া আমি যাব না। ’ শেষমেশ ছোট ভাই আলভীকে নিয়েই চলে যান মা আরজিনা। তত দিন বাবা ও বড় চাচা দুলাল শেখের বাসাতেই ছিল নুসরাত। নুসরাতের মৃত্যুতে সবার মধ্যেই নেমে আসে শোকের ছায়া।
নুসরাতের ফুফা সালাউদ্দিন জানান, নুসরাত তার বাবাকে খুব ভালোবাসত। বাবাকে ছেড়ে থাকত না সে। মৃত্যুর সময়ও সে বাবার সঙ্গে। একই সঙ্গে বাবা-মেয়েকে দাফন করা হয়েছে গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নুসরাতকে হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন আরজিনা ও তার প্রেমিক শাহীন। তাদের বর্ণনা মতে, গভীর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় হামলা হয় জামিলের ওপর। শক্ত কাঠের টুকরার আঘাতে একটু চিৎকার করেছিলেন জামিল। ওই চিৎকারে ঘুম ভাঙে নুসরাতের। জানতে চায় বাবাকে মারার কারণ। অনেক চেষ্টা করে সে বাবাকে বাঁচাতে। এ সময় খুনের একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়ায় শিশুটি। আরজিনাকে দিয়ে তাকে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে দেন শাহীন। রক্তাক্ত বাবাকে রেখে বের হতে চাইছিল না নুসরাত। হাতের শক্ত বাঁধন ছাড়তে আরজিনার দুই হাতে অসংখ্যবার খামচি ও কামড় দেয় সে। জামিলের মৃত্যু নিশ্চিত করে ঘরের বাইরের ছাদে যান শাহীন। সেখানে আরজিনা ও নুসরাত দাঁড়িয়ে। তখনো কান্না থামেনি নুসরাতের। তাকে নিয়ে ভয় শুরু হয় আরজিনা ও শাহীনের, যদি সে আত্মীয়স্বজনসহ সবাইকে জানিয়ে দেয়! এবার সিদ্ধান্ত হলো আরেকটি হত্যার। মেয়েকে চিরতরে বিদায় করতে সায় দিলেন মা আরজিনা। প্রেমিক শাহীনকে বললেন, ‘এটিকেও শেষ করে দাও। ’ প্রথম খুনের প্রায় ৩০ মিনিট পর শিশুটিকে ভিতরে নিয়ে যান তারা। শাহীন বিছানার ওপর নুসরাতের গলা টিপে ধরেন। জীবন বাঁচাতে হাত-পা ছটফট করছিল শিশুটির। তার পা চেপে ধরেন আরজিনা। তখন বুকের ওপর বসা শাহীন। পেট চেপে জোরে গোঙাচ্ছিল নুসরাত। এরপর ওই শব্দ থামাতে নুসরাতের মুখে পাশে থাকা বালিশ দিয়ে চাপা দেন ঘাতক শাহীন। থেমে যায় নুসরাতের ছটফটানি। বন্ধ হয় দেহঘড়ি। খুনিরা বিছানার ওপর আড়াআড়ি করে রাখেন বাবা-মেয়ের লাশ। সকাল পর্যন্ত বাবা আর বোনের লাশের মাঝখানেই ঘুমিয়ে ছিল পাঁচ বছরের শিশু আলভী।
গতকাল আরজিনা ও শাহীনকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এ সময় আদালত শিশু আলভীকে তার বড় চাচা দুলাল শেখে জিম্মায় দেয়। অন্যদিকে আরজিনার দেওয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। অপর আসামি শাহীনের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। এমনটাই জানিয়েছেন বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী ওয়াজেদ আলী।