ট্যুরিস্ট সিজন ও ট্যুরিস্ট। এই দুটি শব্দ ঘিরে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের হোটেল থেকে শুরু করে শুঁটকি, ঝিনুকের তৈরি অলংকার, বার্মিজ আচার, জুতাসহ নানা পণ্যের রমরমা বাণিজ্য শুরু হয়ে যায়। বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর টার্গেট থাকে পর্যটকদের প্রতি। কখন আসবে ট্যুরিস্ট মৌসুম। প্রতি বছর পর্যটন নগরী কক্সবাজারে ঘুরতে আসেন দেশি-বিদেশি লাখো পর্যটক। আর এই পর্যটকদের মূল আকর্ষণ থাকে শুঁটকি ও বার্মিজ আচারের প্রতি। কক্সবাজারে এসে পর্যটকরা বার্মিজ আচার ও শুঁটকি না নিয়ে ফিরে যাবে এটা যেন কল্পনাতীত। বেশির ভাগ পর্যটক শুঁটকি না নিলেও বার্মিজ মার্কেট ঘুরে আচার কিনবে না এটা হতেই পারে না।
সম্প্রতি এই প্রতিবেদক কক্সবাজারে অবস্থানকালে ঢাকা থেকে কক্সবাজারে ঘুরতে আসা ব্যাংককর্মী আরিফুল ইসলাম দোলন বার্মিজ আচার নিয়ে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখানে এসেছি গত দুই দিন আগে। এসে বার্মিজ মার্কেট থেকে চার প্যাকেট আচার কিনি। তারপর হোটেলে গিয়ে আচার খুলে দেখি, সবগুলো আচার কেমন যেন গন্ধ হয়ে গেছে। খেতে গিয়ে দেখি সবগুলোই বিস্বাদ। প্রতিটি আচারের প্যাকেটের ভেতরেই বালুতে ভর্তি। দোলনের কথার সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নেমে মিলেছে এই পর্যটকের কথার সততা।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, পর্যটন নগরী কক্সবাজার এখন নকল পণ্যে সয়লাব। বার্মিজ নামে নকল পণ্যের ছড়াছড়ি বার্মিজ মার্কেটসহ পুরো শহর ও শহরতলির দোকানগুলোয়। নকল পণ্যের পসরা সাজিয়ে রাখেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। কথিত বার্মিজ আচার ও স্যান্ডেলের ওপর পর্যটকদের আগ্রহের কোনো কমতি নেই। তাই দুটি পণ্যই ভেজাল ও নকল হচ্ছে দেদার। কক্সবাজার শহর ও শহরতলিতে ভেজাল আচার তৈরির জন্যই গড়ে উঠেছে অন্তত ২১টি নকল কারখানা। যার কোনো অনুমোদন নেই। এমনকি নকলের ভিড়ে আসল চেনা কষ্টকর হয়ে পড়েছে পর্যটকদের কাছে। নকলের ঠেলায় আসল পণ্য উধাও হওয়ায় ভেজাল আচার কিনে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন পর্যটকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজারে ভেজাল আচার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা ও ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ভেজাল আচার তৈরির কারখানার মালিক ও বিক্রেতাদের আটক-পরবর্তী সাজা দেওয়া হয়েছিল। কিছুদিনের জন্য তৎপরতা বন্ধ হলেও পর্যটন মৌসুমের শুরুতে বেড়ে যায় এদের তৎপরতা। এই পর্যটন মৌসুম শুরুর আগেই বিক্রির জন্য এসব ভেজাল আচার তৈরির কারখানায় এবং আচার বিক্রির দোকানগুলোয় মজুদ করা হয়েছে অন্তত ১০ কোটি টাকার হরেক রকমের ভেজাল আচার।
সৈকতের লাবণী পয়েন্টের ছাতা ও ঝিনুক মার্কেটে, সুগন্ধা পয়েন্ট, কলাতলি পয়েন্ট, শহরের বিভিন্ন মার্কেটে, হোটেল-মোটেল জোনসহ পর্যটক সমাগম এলাকায় বিক্রি হচ্ছে ভেজাল আচার। এসব আচারের স্থায়িত্ব রক্ষার নামে ব্যবহৃত হচ্ছে রং, কেমিক্যাল ও ক্ষতিকর ফরমালিন। বার্মিজ মার্কেট, সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা পয়েন্ট ও হোটেল-মোটেল জোন ঘুরে দেখা গেছে, অর্ধশতাধিক দোকানে এসব ভেজাল আচার মজুদ করে রাখা হয়েছে।
কক্সবাজার থানার ওসি রণজিত কুমার বড়ুয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আসেনি। যদি অভিযোগ পাই সঙ্গে সঙ্গে আমরা এদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। যারা এমন কাজ করছে তারা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কাজ করছে বলেও জানান তিনি।’
মুঠোফোনে কথা হয় কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডাক্তার মো. আবদুস সালামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ভেজাল আচার স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকারক। এমনিতেই আচারটা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। তার ওপর নকল আচার তো আরো বেশি ক্ষতি করবে। আচারটা তৈরি হওয়ার পরে ওখানে পোকা হয়ে যায়। যা খালি চোখে দেখা যায় না। এর কারণে অনেকের অ্যালার্জি, পাতলা পায়খানাও হয়। এ ছাড়া আরো নানান উপসর্গ দেখা দেয়।
ভেজাল আচার বিক্রির দোকানে আকর্ষণীয় ও রঙিন মোড়কের প্যাকেটে মিয়ানমারের (বার্মিজ) ভাষায় টেকসই সুতির লুঙ্গি লেখা ও রাখাইন নারীর ছবি দিয়ে দেদার বিক্রি করা হচ্ছে এসব ভেজাল আচার। কিন্তু প্যাকেট খুলে গুণগত মান নিয়ে হতাশ পর্যটকরা। স্নেহা বিশ্বাস নামের আরেক পর্যটক অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি যে কয়েকবার আচার কিনে ঢাকায় নিয়ে গেছি প্রতিবারই খারাপ আচার পেয়েছি। হয় বালু থাকে, না হয় গন্ধ থাকে অথবা নষ্ট থাকে।’
আমিন নামের এক আচার বিক্রেতা বলেন, ‘আমাদের এখানে ভালো আর অরিজিনাল আচারের পাশাপাশি নকল আচারও পাওয়া যায়। আমরা কী করব বলেন? বার্মা থেকে ভালো আচার আনতে যে খরচ হয় তার দাম ক্রেতারা দিতে চান না। তারা শুধু কম দামি আচার খোঁজেন। তাই আমাদেরও সব ধরনের আচার রাখতে হয়। কেউ ভালো চাইলে আমরা তাদের ভালোটাই দিই।’ এক বিক্রেতা জানান, বার্মা থেকে আমদানি করা আচারের প্যাকেটে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ থাকে না। কতিপয় নকল আচার প্রস্তুতকারী পুরোনো প্যাকেটে ঢুকিয়ে দেন সদ্য তৈরি করা নকল আচার।
আরো জানা গেছে, আমিন (বাহারছড়া), বউ করিম (বিজিবি ক্যাম্প, ঝিলংঝা), মো. ইউনুস (লার পাড়া, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল), পুতু (দক্ষিণ ডিককুল, ঝিলংঝা), বাটপার জসিমউদ্দিন (বন্দনপাড়া, সমিতি পাড়া), নেজামউদ্দিন (লারপাড়া), মো. রহিম (লারপাড়া), মো. ফরহাদ (লারপাড়া), নুরুল আজিম (পূর্ব লারপাড়া) ও মো. হাফেজ (খুরুস্কুল) ছোট ছোট খুপড়ি ঘরে এসব নকল আচার তৈরির কারখানা গড়ে তুলে অবাধে ব্যবসা করে আসছে। ভেজাল আচার প্রস্তুতকারী এমন কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। আবার কারো নম্বর বন্ধও পাওয়া যায়।