কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প–এর একটি ব্লকের মাঝি মোঃ আয়ুব। তার অধীনে রয়েছে শতাধিক বস্তিঘর বা রোহিঙ্গা তাঁবু।
এসব তাঁবুতে আছে প্রায় ছয় শতাধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু। এর মধ্যে গর্ভবতী মহিলাও আছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী দুজন এবং রয়েছেন মিয়ানমার সেনা সদস্য দ্বারা ধর্ষিতা দুজন নারীও। টেকনাফ-কক্সবাজার সড়ক লাগোয়া এই তাঁবুগুলোয় ত্রাণের তেমন ঘাটতি নেই। তাই এখন অভাবও এদের তাড়া করছে না।
কিন্তু কয়েক দিন ধরে এদের অনেকের ভিতর একটি বিষয় বেশ তাড়া দিচ্ছে, আর তা হচ্ছে আতঙ্ক— মিয়ানমারে তাদের ফিরিয়ে নেওয়া চুক্তির আতঙ্ক!
গত বৃহস্পতিবার মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের একটি সমঝোতা হয়েছে— দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়া শুরু করবে মিয়ানমার। ৭ লাখ রোহিঙ্গা স্বদেশে ফিরিয়ে নেবে।
চুক্তির পর থেকেই জানা-অজানা আতঙ্ক ভর করছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে।তারা বলছেন, ‘এখানে কষ্টে আছি। তবু বেঁচে তো আছি। দেশে গেলে বেঁচে থাকতে পারব তো!
বালুখালীর লালু মাঝি বলেন, ‘এখানকার অধিকাংশ রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরে যেতে চায়, নিজেদের বসতভিটায় স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস ফেলতে চায়।
সে আরো জানায়, রোহিঙ্গাদের সমান সুযোগ দিতে হবে, যেমনি রাখাইনরা পায়। কুতুপালং নতুন বস্তিতে আশ্রিত মিয়ানমারের খেয়ারি প্রাংয়ের শামসুল নবী (৬৫), মংডুরে শহরের লামার পাড়ার মহিলা মিজানা বেগম (৩২), রাইম্ম্যাংখালীর হাসিনা বেগম (৩৮), তুমব্রু জিরো পয়েন্টে আশ্রিত আবদুর শরীফ (৫৫),স্ত্রী শামসুন্নাহার (৪৫), বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প -২ আশ্রিত মিয়ানমারের ঢেকিবনিয়া গ্রামের কামাল উদ্দিন সহ শতশত রোহিঙ্গা নারী পুরুষের এক বাক্য মগেরা (রাখাইন) যেমন সরকারি সুযোগ -সুবিধা পাচ্ছে, তেমনি আমাদেরও (রোহিঙ্গাদের) দিতে হবে।
বাস্তুভিটা ফেরৎ দিতে হবে তাহলেই স্বদেশে ফিরে যাবেন। তারা আরো বলেন মগ সরকার ফিরিয়ে নিয়ে আবার যদি দমন -পীড়ন চালায়! এমন শংকাও করেন। মিয়ানমার মিলিটারি যদি আবার নির্যাতন শুরু করে, আবার যদি আমাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয় তাহলে কী হবে। যদি মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ আবার সন্ত্রাসী-জঙ্গি দমনের নামে নারী নির্যাতন, ধ্বংসাত্মক তাণ্ডব চালায় তাহলে আমরা কোথায় যাব?’
এই কথা শুধু এপারে আশ্রিত লালু আর আয়ুব মাঝি কিংবা ১০-২০ বা শতশত রোহিঙ্গার নয়, লাখো রোহিঙ্গার দাবী শান্তিতে ফিরে স্বাধীন বসবাস করা। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এখন সে দেশে ফিরে যাওয়ার আতঙ্কে রয়েছেন।
তারা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে যেমন আতঙ্কে, তেমন তাদের ভিটেমাটি ফেরত পাবেন কিনা, তা নিয়েও আশঙ্কায় রয়েছেন। বালুখালী ক্যাম্পেই কথা হয় মিয়ানমারের বুসিদংয়ের মেরুল্যাপাড়া থেকে আসা গর্ভবতী নুর সখিনার সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘আঁরা এড়ে অত বেশি ভালা নাই, ছোড় ছোড় তাঁবু ঘরত থাইকতে আঁরাতো বেশীকষ্ট অঁর। কিন্তু এড়ে তো পরাঁন লই বাঁচি আছি। যদি চলি যাই তো অঁই,আঁরা পোয়াইন্দে লই বাঁচি থাহিত পাইজজুম নে? (আমরা এখানে খুব বেশি ভালো নেই, ছোট ছোট তাঁবুতে থাকতে আমাদের বেশ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এখানে তো প্রাণটা নিয়ে বেঁচে আছি। যদি চলে যেতে হয়, আমরা ছেলেমেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকতে পারব তো?)’
এদিকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ মনে করে, তাদের ফেরত নেওয়া হলেও আগের সেই বসতভিটা, জমিজমা আর ফেরত দেবে না মিয়ানমার সরকার।
তাদের মতে, মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে দীর্ঘদিন ধরে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে শরণার্থী হিসেবে। তাদের নিজেদের যেমন বাড়িঘর নেই, নেই জাতিগত পরিচয়ও। শরণার্থী করেই রাখা হয়েছে এই ৫ লাখ রোহিঙ্গাকে।
নিজ দেশে শরণার্থী হয়ে থাকতে হবে কিনা, তা নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা নতুন-পুরান রোহিঙ্গারা বেশ আতঙ্কিত। তারা রোহিঙ্গা পরিচয়েই তাদের মাটিতে ফিরে যেতে চায় এবং স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে চায়।
এ ক্ষেত্রে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের শিক্ষিত ও সচেতন মহল বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চায়।
দীর্ঘদিনের এই সমস্যার যেন স্থায়ী সমাধান হয়, সেটাই তাদের প্রত্যাশা।জানা গেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে ১৯৯২ সালে সম্পাদিত যৌথ চুক্তির আলোকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা হবে।
আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ তৈরি করা হবে এমন মিলিয়ে অনুমান দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু হবে।
এ ছাড়া দ্রুত সময়ের মধ্যে আরেকটি চুক্তি বা সমঝোতা স্বাক্ষরের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার মূল কার্যক্রম শুরু করার কথা রয়েছে।
তবে আদৌ রোহিঙ্গারা চুক্তিমতে মিয়ানমারে ফিরবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ও কম না।
স্থানীয়দের অভিমত দ্রুত সময়ে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ কামনা করেন উখিয়া-টেকনাফবাসী।
|