ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিরা তাকে যৌনদাসী বানিয়ে রেখেছিল। শত শত ইয়াজিদি মহিলা আইএস জঙ্গিদের হাতে বন্দি। তার মতোই যৌনদাসী হয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। সেই নরক থেকে পালিয়ে এসে ভয়ানক দিনগুলোর অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম। ‘দ্য লাস্ট গার্ল’ বইটিতেই সেই জীবনের কাহিনি তুলে ধরেছেন নাদিয়া মুরাদ।
প্রায় তিন বছর হয়ে গেল, উত্তর ইরাকে আইএস জঙ্গিদের কবল থেকে পালিয়ে এসেছেন মুরাদ। লন্ডনের এক হোটেলে বসে সেই দিনগুলোর কথাই বলছিলেন তিনি। বলেন, ‘কাউকে না কাউকে তো এই কথা তুলে ধরতেই হতো।’ বর্তমানে জাতিসংঘের গুডউইল অ্যাম্বাসেডর মুরাদ আইএস জঙ্গিদের হাতে বন্দি ইয়াজিদি মহিলা এবং যারা জঙ্গিদের হাত থেকে পালিয়ে এসেছে তাদের নিয়ে কাজ করছেন।
সালটা ২০১৪। তখন আইএস জঙ্গিদের দখলে চলে গেছে গোটা উত্তর ইরাক। ইরাকের এই অংশে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ থাকতেন। জঙ্গিরা এসেই গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে দেয়। খুন, ধর্ষণ, লুঠপাট তো চলেই, সেই সঙ্গে ইয়াজিদি মহিলা, তরুণী, কিশোরীদের তুলে নিয়ে যেতে শুরু করে চলে যৌনদাসী বানানোর জন্য। মুরাদ জানান, তার এই বই প্রকাশ করার একমাত্র লক্ষ্য-গোটা বিশ্ব জানুক, কীভাবে ইয়াজিদি মহিলাদের ওপর অত্যাচার চালায় আইএস।
উত্তর ইরাকের ছোট্ট গ্রাম কোচোতে পরিবারের সঙ্গেই থাকতেন মুরাদ। তিনি তখন পড়াশোনা করছেন। গ্রামের প্রতিটি পরিবারই খুব গরিব। কিন্তু দারিদ্র্য কখনো সেই গ্রামের খুশি কেড়ে নিতে পারেনি। সব ঠিকঠাকই চলছিল। ২০১৪ সালে গ্রামে জঙ্গিরা এলো। বুড়ো-বাচ্চা সবাইকে গ্রামেরই একটা স্কুলে ঢুকিয়ে দিল তারা। মহিলাদের থেকে পুরুষদের আলাদা করে দেওয়া হলো। তাদের রাখা হলো স্কুলের বাইরে। তার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির আওয়াজ, আর সেই শব্দকে ছাপিয়ে মানুষের আর্তনাদ। সেদিন মুরাদের ছয় ভাইকেও গুলি করে মেরেছিল জঙ্গিরা।
এরপর মুরাদ ও গ্রামের অন্য মহিলাদের একটা বাসে করে নিয়ে যাওয়া হয় মসুলে। বাসে যেতে যেতেই চলে শারীরিক নিগ্রহ। মসুলে নিয়ে গিয়ে অল্পবসয়ী মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। মুরাদের দাবি-একজন তার পেটে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়। সেই ব্যক্তিই তাকে কিনে নেয়। অনেক ইয়াজিদি মহিলা সম্ভ্রম বাঁচাতে আত্মহত্যা করেন।
মুরাদ বলেন, ‘নরক থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। ধরা পড়তেই চলে গণধর্ষণ। ভেঙে পড়িনি। আমার মতোই হাজারো মহিলা জঙ্গিদের কব্জায় ছিল, এটাই আমাকে সাহস জুগিয়েছিল। নিজেকে সান্ত¡না দিয়ে বলতে থাকলাম এক দিন মুক্ত হবই’! সেই সুযোগও এসে গেল এক দিন। এক জঙ্গি দরজা না আটকেই বেরিয়ে গিয়েছিল। জঙ্গি চলে যেতেই সোজা দৌড়। আর পেছনে ফিরে তাকাননি। ‘ধরা পড়লেই মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সাহসে ভর করে বেরিয়ে পড়েছিলাম’- বলেন মুরাদ। অন্ধকার রাস্তা ধরে বহুক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে একটা বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় চান। সেই পরিবারই তাকে মসুল থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। পরে ২০১৫ সালে জার্মানির শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন তিনি।
মুরাদ বলেন, ‘মসুলে ২০ লাখ মানুষের বাস। দুই হাজার মেয়েকে আটকে রেখেছিল জঙ্গিরা। মসুলের বাসিন্দারা কেউ এগিয়ে আসেনি তাদের উদ্ধারে। যারা এগিয়ে এসেছিলেন তারা হাজার হাজার ডলার দাবি করছিলেন।’ বন্দি থাকাকালীন ইউরোপ, সৌদি আরব, তিউনিশিয়া থেকে একের পর এক জঙ্গি আসত, আর নিত্যদিন ধর্ষণ করত তাকে। ধর্ষণের আগে প্রার্থনাও করিয়ে নেওয়া হতো।
তার মতো অনেক ইয়াজিদি মহিলা এখনো আইএস জঙ্গিদের কবলে। মুরাদ বলেন, ‘জানি কী দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন তারা। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই আজ সেই সব মেয়েদের কাহিনি তুলে ধরছি।’ মুরাদ মেকআপ আর্টিস্ট হতে চান। নিজের একটা স্যালো খুলতে চান। আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে চান তিনি।