‘আমি আসলে নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা এবং আমার পক্ষে ঘুরে বেড়ানো একটু সমস্যা’-পাথরের খাড়া সিঁড়িগুলো দিয়ে আস্তে আস্তে নিজের ক্লিনিকের দিকে উঠতে উঠতে বলছিলেন ধাত্রী ফাতিমা। কিন্তু আমি এখানে আসি আমার রোগীদের জন্য। প্রসবের সময় চিকিৎসক বা প্রশিক্ষিত ধাত্রী উপস্থিত থাকলে ৯৯ শতাংশ প্রসূতির মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। পাকিস্তানে গর্ভাবস্থার জটিলতা বা বাচ্চার জন্ম দেওয়ার সময় প্রতি ২০ মিনিটে একজন নারী মারা যায় বলে জানাচ্ছে গ্রামীণ উন্নয়ন-সংক্রান্ত সংস্থা সেন্টার অব একসেলেন্স ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট।
ফাতিমা কাজ করেন সেহত কাহানি নামের একটি সংস্থার সঙ্গে; যারা প্রশিক্ষণ দেয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধাত্রীদের এবং নারী চিকিৎসকদের সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ করিয়ে দেয় ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে। এভাবে ভিডিওতে পরামর্শের জন্য খুবই অল্প পরিমাণ অর্থ খরচ হয়, যা শুরু হয় ৫০ রুপি (১.৩০ ডলার) থেকে। ফলে অনুন্নত অঞ্চলে বহু নারী কম খরচে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পরিসেবা পেতে পারেন।
রুবিনা জানান, ‘আমি দুটি মৃত ছেলের জন্ম দিয়েছি, চারবার গর্ভস্রাবের কারণে নষ্ট হয়েছে পেটের বাচ্চা। এখন আমি দুই মাসের গর্ভবতী।’ তিনি জানান, আগের গর্ভাবস্থার সময় অসম্ভব মাথাব্যথা, মাথাঘোরা এবং হাত-পায়ে ফোলা ভাব ছিল তার। এগুলো এক্লামসিয়া রোগের পূর্ব লক্ষণ, যা সাধারণত একধরনের অত্যন্ত উচ্চ রক্তচাপের লক্ষ্মণ, যা মা এবং গর্ভস্থ শিশু দুজনেরই মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
ইসলামাবাদে যখন তিনি শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে পৌঁছলেন, বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। তার যমজ সন্তানরা বাঁচেনি। ওরা যখন আমার আলট্রাসাউন্ড করল, ওরা বলল, ১৫ দিন আগেই বাচ্চা দুটি মারা গেছে। দশমবার গর্ভবতী হয়েছেন রুবিনা। কিন্তু এই প্রথমবার প্রশিক্ষিত ধাত্রী এবং চিকিৎসকরা জন্ম-পূর্ববর্তী নিয়মিত পরীক্ষা করছেন রুবিনার।
ফাতিমা প্রথমে রুবিনার রক্তচাপ মাপলেন। নিজের ল্যাপটপে যোগাযোগ করলেন এক চিকিৎসকের সঙ্গে। সবই স্বাভাবিক মনে হলো। ‘পড়শি এক নারী আমাকে প্রথম বলল, সেহত কাহানির সঙ্গে যোগাযোগ করতে’- জানালেন রুবিনা। ‘এখানে এসে মনে হচ্ছে, আগে সন্তান নষ্ট হয়ে গেলেও এবার ঠিকভাবেই সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে পারব।’
রুবিনা পরীক্ষাঘর ছেড়ে বেরোনোর পর ফাতিমা বললেন, ‘ওদের জন্য খুব কষ্ট হয়। একমাত্র মা-ই জানে বারবার পেটের বাচ্চা নষ্ট হওয়ার যন্ত্রণা কেমন।’ ফাতিমা বলছেন, ‘পরিবার থেকে অনুমতি পাইনি বলে আগে এ ধরনের কাজ করতে পারিনি। যেহেতু শুধুই মেয়েদের সঙ্গে আমি কাজ করি, তাই কাজ করার অনুমতি পেয়েছি। পুরুষদের সঙ্গে কাজ করার অনুমতি আমার ছিল না।’
মেয়েদের কাজের জন্য বাইরে যেতে দেওয়ার অনুমতি দিতে পরিবারের অনাগ্রহের ফলে পাকিস্তানের বহু প্রশিক্ষিত নারী চিকিৎসক এবং ধাত্রী এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশ নিতে পারছেন না। পাকিস্তানের মেডিক্যাল এবং ডেন্টাল কাউন্সিল বলছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়ছে ৭০ শতাংশের বেশি মেয়ে, কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাবেন তাদের মাত্র অর্ধেক।
ড. ইফ্ফাত জাফর ও ড. সারা সাঈদ গড়ে তুলেছেন সেহাত কাহানি, আমরা দুজনেই পাস করা ডাক্তার। পাকিস্তানের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছিলাম চিকিৎসা শাস্ত্রে, জানালেন ড. সারা সাঈদ। দুজনের ক্ষেত্রেই বাড়ি থেকে তীব্র আপত্তি এসেছিল বিয়ের পর কাজে ফেরার ক্ষেত্রে। বিশেষ করে বাচ্চাকাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর। তাই যারা কাজে ফিরতে পারেনি, তাদের সমস্যাটা আমরা বুঝতে পারি।
২০১৪ সালে তারা শুরু করেছিলেন ‘ডক্টহারস’ নামে একটি সেবা’, যাতে তারা বাড়ি থেকেই ভিডিও-লিঙ্কের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা দিতে পারতেন। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের বহু জায়গায় যেখানে স্বাস্থ্য পরিসেবার অভাব ছিল সেখানে তারা স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছেন।
২০১৭ সালে সারা এবং ইফ্ফাত মেয়েদের প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়ে নজর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তারা গড়ে তোলেন সেহত কাহানি- উর্দুতে যার অর্থ ‘স্বাস্থ্যকথা’। সারা বলেন, ‘আমরা দেখলাম, বেশির ভাগ মানুষই চিকিৎসাকেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছতেই পারছেন না। কাজেই আমরা ঠিক করলাম, একজন ধাত্রী বা নারী চিকিৎসাকর্মী তার সঙ্গে ট্যাবলেট বা কম্পিউটার এবং ব্যাগ নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাবে। যারা ক্লিনিকে যেতে পারছে না, তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শ দেবে।’
তাইয়াবা আঞ্জুম আলি চার সন্তানের মা। তিনি বলেন, ‘প্রথমবার গর্ভাবস্থায় খুব কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু এবারে ব্যাপারটা অনেক সহজ ছিল। বাড়িতে ছোট বাচ্চাদের একা রেখে বেরোতে না পারলে আমি টেলিফোনে ধাত্রীদের বাড়িতে ডাকতে পারছি, যাতে তারা বাড়িতে এসেই পরীক্ষাগুলো করে নিতে পারছেন।’ স্বাস্থ্যকর্মী ফাতিমা বলেন, ‘আমার মেয়েরা চিকিৎসকদের কাছে যাওয়ার দরকার মনে করে না। আমি এমন একটি সংস্থার সঙ্গে কাজ করছি যারা এসব ব্যাপারে মেয়েদের সচেতনতা বাড়াতে চেষ্টা করছে, একই সঙ্গে ভালো চিকিৎসকদের সাহায্যও দিচ্ছে।’ দ্য বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের এই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে দ্য বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।
|