রাজধানীতে কাজে আসছে না জাতিসংঘের নিরাপদ খাদ্যকার্যক্রম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা পরিচালিত ‘ইম্প্রুভিং ফুড সেফটি ইন বাংলাদেশ’ নামে ওই কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। রাজধানীর প্রায় সব স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পার্কের সামনে, জনবহুল জায়গায় এ ধরনের অনিরাপদ পথখাবার বিক্রি বন্ধ করতে ২০১৬ সালে এই কার্যক্রম চালু করা হয়। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও কাজে আসেনি এসব কার্যক্রম। জানা গেছে, পথখাবারের প্রধান ক্রেতা হচ্ছেন ছোট শিশু শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও পথচারী। এ খাবারগুলো খেয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা।
জানা যায়, ২০১৫ সালে আইসিডিডিআরবির সঙ্গে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এক জরিপ পরিচালনা করে। সেখানে দেখা যায়, ঢাকায় ১০ হাজারেরও বেশি স্ট্রিট ফুড বা পথখাবার বিক্রেতা আছেন। তারা সব সময় অনিরাপদ পথখাবার বিক্রি করে আসছিলেন। পরে ‘ইম্প্রুভিং ফুড সেফটি ইন বাংলাদেশ’ কার্যক্রমের আওতায় পরীক্ষামূলকভাবে ‘স্ট্রিট ফুড ভ্যান’ নামে নিরাপদ খাবার পরিবেশনের জন্য ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশন এ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশনে পথখাবার বিক্রেতাদের নিবন্ধন সম্পন্ন করতে পারলেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পথখাবার বিক্রেতারের নিবন্ধন সম্পন্ন করতে পারেনি। তবু এ প্রকল্পের আওতায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মোট ৬০০ স্ট্রিট ফুড ভ্যান তৈরি করে দিয়েছে। বিতরণ করা প্রতিটি গাড়িতে রান্নার জন্য একটি করে চুলা, জীবাণুমুক্ত খাবার তৈরি ও পরিবেশনের জন্য হ্যান্ডস গ্লাভস, সাবান, জীবাণুমুক্ত পানির জন্য পানির বিশেষ প্রযুক্তির ফিল্টারসহ আধুনিক খাবার তৈরির যাবতীয় ব্যবস্থা ছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘ইম্প্রুভিং ফুড সেফটি ইন বাংলাদেশ’ কার্যক্রমের সিনিয়র ন্যাশনাল অ্যাডভাইজর অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, ‘আইসিডিডিআরবির ওই জড়িপে উঠে এসেছে ঢাকার পথখাবার বিক্রেতারা ৮৮ শতাংশই ঠিকমতো হাত না ধুয়েই বারবার খাবার পরিবেশন করেন। তারা নোংরা পানিতে প্লেট-চামচ ধুয়ে খাবার দেন। তখন আমরা এক প্রকল্পের মাধ্যমে স্ট্রিট ফুড ভ্যান তৈরি করে দিয়েছি। কিন্তু পরে দেখা গেছে, সেগুলো প্রত্যাশিত হারে ব্যবহার করছেন না। খুলনা ও বরিশালে পথখাবার বিক্রেতাদের নিবন্ধন করেতে পাড়লেও ঢাকায় এটা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে পথবিক্রেতার সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি পরিস্থিতিও আরো খারাপ হয়েছে।’ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা উত্তম কুমার বলেন, বর্তমানে এ প্রকল্প বন্ধ আছে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য সফল না হওয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাই এ প্রকল্পের খোঁজ কেউ রাখেন না।
গতকাল বিকেলে সরেজমিনে রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় শিশুপার্কের সামনে গিয়ে দেখা গেল, প্রধান ফটকের সামনে ঝালমুড়ি, ফুসকা, চটপটি, ভেলপুরি, পেয়ারা-আমরা-আনারস-পাকা পেঁপে, নানা রকম আচারসহ চাটনির দোকান। শিশুদের সঙ্গে থাকা অভিভাবকরাও এসব খাবার খাচ্ছেন। শিশুপর্ক এলাকাকায় আচার বিক্রেতা আবদুল্লাহ আল মামুন বিভিন্নজনের কাছে বিভিন্ন ধরনের আচার বিক্রি করছেন। কেউ আমসত্ব নিচ্ছেন; কেউবা তেঁতুল। তিনি পেঁপারের কাগজের ছেঁডা অংশে হাত দিয়ে এসব আচার খাবার দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সবকিছু কিনে এনে বিক্রি করি। এগুলো তৈরিতে কী ব্যবহার করা হয় তা বলতে পারি না।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ফুটপাতে বেশ কিছু বিক্রেতা পেয়ারা, আমরা, আনারস কেটে বিক্রি করছেন মো. হোসেন। তিনি এক বালতি ময়লাপানির মধ্যে একের পর এক ময়লা প্লেট ফেলছেন। আর নাড়াচড়া দিয়েই তুলছেন। এই প্লেটেই ক্রেতাকে দিচ্ছেন আনারাস। কাউকে পাকা পেঁপে দিচ্ছেন। এটি স্বাস্থ্যসম্মত কি-না? এতে বিক্রেতা কিংবা ক্রেতা কারোরই নজর নেই। অথচ কয়েক দিন আগে সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকার ৯০ শতাংশ পথখাবারই অনিরাপদ। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) গবেষণায় পথখাবারে জীবাণুর হার ছিল ৫৫ শতাংশ। বেশির ভাগই পাওয়া গেছে স্কুলের সামনের পথখাবারে। এ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকায় দুই বছরের মধ্যে পথখাবারে জীবাণুর সংক্রমণ বেড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ।
ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির প্রধান অধ্যাপক ডা. শাহনীলা ফেরদৌসী জানান, ‘পথের পাশে খাবার পানি, তৈরি খাবার, সংরক্ষণ পর বিক্রি করা খাবার নিয়ে আমরা গবেষণা করেছি। এসব খাবার জীবাণুযুক্ত। আর এসব জীবাণু থেকেই সাধারণ মানুষ আমাশয়, ডায়রিয়া, টাইফয়েড ও জন্ডিসের মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।’
অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন আরো বলেন, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এই গাড়িগুলো সরবরাহ করেছে। খাবার বিক্রেতাদের নিরাপদ খাবার তৈরি ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়েছে আইসিডিডিআরবি। এত কিছুর পরও তা থেকে আশানুরূপ কিছু হচ্ছে না। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান বলেন, ‘স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের মাধ্যমে আমরা নজরদারি করার চেষ্টা করছি। কিছু সংকট ও সমস্যা আছে। এগুলো কাটিয়ে উঠতে পাড়লে সফলতা আসবে।’