পুনঃতফসিলের ‘উদার নীতি’র কারণে ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক ঋণ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।
রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে ‘উদার নীতি’ নিয়ে এ মন্তব্য করা হয়। শুধু ২০২৩ সালেই ব্যাংকগুলোর পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯১ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা এক বছরে এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ।
খেলাপি ঋণ কম দেখাতে পুনঃতফসিলের সুযোগ করে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তার ‘উদার নীতি’র কারণে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। শুধু এক বছরেই (২০২৩ সাল) ব্যাংকগুলোর পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯১ হাজার কোটি টাকার বেশি। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সব মিলে গত বছর শেষে ব্যাংক খাতের পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা বা মোট বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২০১৯ সালে ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিল করে ৫২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার। ২০২০ সালে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয় ১৯ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। পরের বছর ২০২১ সালে ঋণ পুনঃতফসিল করা হয় ২৬ হাজার ১১০ কোটি, ২০২২ সালে ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি এবং ২০২৩ সালে ৯১ হাজার ২২১ কোটি টাকা। তথ্য বলছে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে পুনঃতফসিল ঋণ বেড়েছে ৪৩ শতাংশের (৪৩.১৫) বেশি।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৩ সালে পুনঃতফসিল ঋণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাড় নীতি আর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দায়ী। নির্বাচনে প্রার্থী হতে গত বছরের শেষ দিকে অনেকই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত হন, ছাড় পান খেলাপি থেকে। পাশাপাশি আর্থিক হিসাব ভালো দেখাতেও শেষ প্রান্তিকে অনেক খেলাপি গ্রাহকের ঋণ উদারনীতির মাধ্যমে নবায়ন করা হয়। ২০২২ সালের জুলাইয়ে পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এসেই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের পুরো ক্ষমতাই ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেন। সঙ্গে ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালাও শিথিল করা হয়। তার উদার নীতির কারণে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যায়।
তথ্য বলছে, ২০২৩ সাল শেষে দেশের ব্যাংক খাতের পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা বা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এর আগের বছর ২০২২ সালে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি। বিগত ২০২১ সালে ছিল ১ লাখ ৬৮ হাজার ৩৯০ কোটি, ২০২০ সালে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৬৩০ কোটি এবং ২০১৯ সালে ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৩০ কোটি টাকা।
শিল্প উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন। গত বছর শেষে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ স্থিতির ২৬ দশমিক ৪ শতাংশই ছিল শিল্প খাতের। এর পরের স্থানে ছিল বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাত। বস্ত্র ও পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা ২০ দশমিক ৯ শতাংশ ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন। এছাড়া ১১ দশমিক ৩ শতাংশ চলতি মূলধন, ব্যবসায়িক ১১ শতাংশ, আমদানি ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, ৬ দশমিক ৫ শতাংশ নির্মাণ, ৫ দশমিক ২ শতাংশ কৃষি খাতে এবং ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অন্যান্য খাতে।
ব্যাংকাররা বলছেন, এখন ঋণ নিয়মিত করতে আড়াই থেকে সাড়ে চার শতাংশ অর্থ জমা দিলেই হয় নিয়মিত হয়। আগে এটা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব ঋণ পরিশোধে গ্রাহকদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে পাঁচ থেকে আট বছর, আগে যেটা সর্বোচ্চ ছিল তিন বছর। আবার বিশেষ বিবেচনায় কোনো খেলাপি ঋণ চারবার পর্যন্ত পুনঃতফসিলের সুযোগ রাখা হয়েছে, এর আগে তিনবারের বেশি পুনঃতফসিল করা যেত না। ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদই খেলাপি ঋণ নবায়নের সিদ্ধান্ত দিতে পারছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭২২ কোটি টাকা আর পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অযোগ্য হওয়ায় ৭১ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে ব্যাংকগুলো।