খালেদা জিয়ার মামলার কার্যক্রম পরিচালনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে আর যুক্ত থাকতে পারছেন না দলের অন্যতম নীতিনির্ধারক ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। দলের এই স্থায়ী কমিটির সদস্যকে তার সব মামলার কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন খালেদা জিয়া। অর্থাৎ এখন থেকে বেগম জিয়ার মামলায় মওদুদ আহমদকে দেখা যাবে না। তবে দলীয় কার্যক্রমে স্বাভাবিকভাবেই অংশগ্রহণ করতে পারবেন তিনি। বিএনপির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
রবিবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার ৬ আইনজীবী দেখা করতে গেলে তিনি তাদের এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেন। গত কিছুদিন ধরে মামলার কার্যক্রম পরিচালনা নিয়ে দলের আইনজীবীদের দ্বন্দ্ব-কোন্দলের মধ্যে এ কঠোর নির্দেশনা এলো। এ ছাড়া গাজীপুর ও খুলনাসহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে কিনাÑ এ বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে নেতাদের নির্দেশ দেন।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ কয়েক নেতা বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলেও জানা গেছে।
খালেদা জিয়ার মামলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আইনজীবী ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, অ্যাডভোকেট আবদুর রেজাক খান, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, অ্যাডভোকেট এজে মোহাম্মদ আলী, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ওইদিন বিকালে বিএনপিপ্রধানের সঙ্গে দেখা করতে নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কারাগারে যান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন আমাদের সময়কে বলেন, মামলার আইনগত বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তার মামলায় জামিন হচ্ছে না কেন? তা জানতে চেয়েছেন। আমরা আদালতের বিষয়গুলো বলেছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনৈতিক বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
সূত্র জানিয়েছে, খালেদা জিয়ার মনোভাব দেখে মনে হয়েছে, তিনি আইনজীবীদের ওপর কিছুটা অসন্তুষ্ট। কথা বলার সময় কয়েকবার রাগান্বিত হয়েছেন। তার মামলা পরিচালনায় ভুল হচ্ছে কিনা বার বার জানতে চেয়েছেন। এক পর্যায়ে বেগম জিয়া তার মামলার আইনি সব কার্যক্রম থেকে মওদুদ আহমদকে বিরত রাখার নির্দেশ দিয়ে বলেন, তার এবং তারেক রহমানের সব মামলার আইনি কার্যক্রমের বাইরে থাকবেন তিনি। এ সময় বেগম জিয়া এ-ও বলেন, মওদুদ আহমদ দলীয় কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চালাতে পারবেন।
এ বিষয়ে গতকাল সন্ধ্যায় আমাদের সময়ের সঙ্গে দলের এক দায়িত্বশীল নেতার আলাপ হয়। ওই নেতা বলেন, বেগম জিয়া এমন নির্দেশনা কেন দিলেন তা জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, মওদুদ আহমদকে নিয়ে এখন সন্দেহ করার কিছু নেই। তিনি বেগম জিয়ার ওপর শতভাগ আস্থা রেখে দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি অন্ততপক্ষে তাকে ‘ষড়যন্ত্রে’ লিপ্ত বলে মনে করি না। তবু দলীয় চেয়ারপারসন ভালো জানেন। তিনি জেনে-বুঝে হয়তো সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। দলের কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন কারাগারে যাওয়ার পর থেকে সিনিয়র কয়েক নেতার সঙ্গে তার ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয়। দলীয়প্রধানের মুক্তির দাবিতে চলমান আন্দোলনের প্রথম দুই কর্মসূচির ব্যাপারে তাকে জানানোই হয়নি।
এ পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনার এক পর্যায়ে মামলা পরিচালনার দায়িত্বে কে কে থাকবেন তা জানতে চাইলে বেগম জিয়া বলেন, খন্দকার মাহবুব হোসেন এবং এজে মোহাম্মদ আলী। এ সময় খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘আমি, জয়নুল আবেদীন এবং মাহবুব উদ্দিন খোকন মামলা পরিচালনা করতে চাই।’ তখন বেগম জিয়া ফের নির্দেশ দেন, মাহবুব হোসেন এবং এজে মোহাম্মদ আলী মামলা পরিচালনা করবেন। এ সময় খন্দকার মাহবুব আবারও তার কথা পুনরায় উল্লেখ করলে বেগম জিয়া একটু বিরক্তি প্রকাশ করেন।
এ ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্ট বারের সভাপতি জয়নুল আবেদীন আমাদের সময়কে বলেন, কারো নেতৃত্বে নয়, সবার সমন্বয়ে মামলা চলবে।
মওদুদ আহমদকে মামলা থেকে বিরত থাকার নির্দেশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ রকম কোনো ঘটনা নেই। এ কথা কে বলেছে?’
আলোচনার এক পর্যায়ে মাহবুব উদ্দিন খোকন বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার নওশাদ জমির ও ব্যারিস্টার কায়সার কামালের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বলেন, তারা অপেক্ষাকৃত জুনিয়র, অভিজ্ঞতাও কম। তারা এ প্রক্রিয়ায় না থাকলেই ভালো। এ পর্যায়ে বেগম জিয়া কোনো নির্দেশনা না দিয়ে স্বৈরাচার এরশাদের আমলে মওদুদ আহমদের এপিএস ও নতুন বাংলা ছাত্রসমাজের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মাহবুব উদ্দিন খোকনের ওপর একটু বিরক্তি প্রকাশ করেন। বলেন, সিনিয়র ও জুনিয়ররা মিলেই আইনি লড়াই চালাবে।
বৈঠক সূত্র আরও জানিয়েছে, জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে এদিন কোনো কথা হয়নি। তবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিষয়ে বেগম জিয়া দল ও জোটের নেতাদের বৈঠক করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশ দেন। বেগম জিয়ার এ নির্দেশের পর বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যাবে কিনা, সেটি প্রশ্ন হয়ে থাকল।
আইনজীবীদের দ্বন্দ্ব যেভাবে শুরু : জানা যায়, বিগত দুই-তিন বছর যাবৎ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলাগুলো এককভাবে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মদ আলী পরিচালনা করে থাকেন। এ কারণে বর্তমান প্রেক্ষাপটে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় উচ্চ আদালতের শুনানিতে তিনিই মূল ভূমিকা রাখছেন। তার সঙ্গে সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, খন্দকার মাহবুব হোসেন, জয়নুল আবেদীন, আবদুর রেজাক খানসহ অনেকেই উপস্থিত থাকেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অনেক সময় শুনানিতেও অংশ নেন।
মামলা পরিচালনায় এজে মোহাম্মদ আলীর সামনে থেকে ভূমিকা পালনকে দুই-একজন সিনিয়র আইনজীবী ততোটা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেননি। এ কারণে কিছুটা বিভক্তি লক্ষ করা যায় বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের মাঝে।
দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার পক্ষে হাইকোর্টে আপিল দায়েরের পর থেকে এ বিষয়ে শুনানিকালে কোনো দিনই ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ শুনানিতে অংশ নেননি; তিনি কেবল উপস্থিত থাকেন।
সর্বশেষ ১৯ মার্চ আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করে খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত করে দেন। আদালত থেকে বিএনপির জন্য এ ধরনের একটি অপ্রত্যাশিত আদেশ আসার পরও সামনের সারিতে বসা বেশ কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবী নিশ্চুপ ছিলেন। এ অবস্থায় পেছনের সারিতে বসা অপেক্ষাকৃত কিছু জুনিয়র আইনজীবী সিনিয়রদের আদালতের উদ্দেশে কিছু বলার জন্য চাপ দেন। অনেকে জামিন স্থগিত করার যুক্তি আদালতের কাছে জানতে বলেন।
কিছুক্ষণ পরে সেদিন খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, মাই লর্ড, আমি দুঃখিত। আপনি কী আদেশ দিয়েছেন সেটি বুঝতে পারিনি। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা সর্বসম্মত হয়ে এ আদেশ দিয়েছি। জয়নুল আবেদীন বলেন, আমি ‘সর্বসম্মত’ এটি জানতে চাইনি। কোন যুক্তিতে লিভ মঞ্জুর করেছেন সেটি জানতে চাই? প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা নথি পর্যালোচনা করেছি। তখন জয়নুল আবেদীন বলেন, আমরা তো মেরিটে (মামলার মূল বিষয়বস্তুতে শুনানি করিনি) বলিনি।
সূত্র জানায়, আদেশের পর সেদিন আদালত থেকে বের হয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েক নেতাকর্মী ও আইনজীবী সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির কক্ষে প্রবেশ করেন। এর কিছুক্ষণ পর ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও খন্দকার মাহবুব হোসেন ওই কক্ষে যান। তখন মহাসচিবের সামনেই বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের কাছে জানতে চান, আপনারা এ ধরনের আদেশের পরও কেন নিশ্চুপ ছিলেন। জবাবে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, আমাদের মতো বয়স হোক তারপর বুঝবে কখন নিশ্চুপ থাকতে হয়। জবাবে সেদিন কায়সার কামাল বলেন, সেই বয়স হওয়ার আগেই যেন মৃত্যু হয়, যে বয়সের কোনো সিদ্ধান্ত দলের স্বার্থের বিপক্ষে যায়।
|