বিদায়ী বছরজুড়ে শিক্ষা খাতে ছিল নানা বিতর্ক। সমালোচনা শুরু হয় বছরের প্রথম দিন থেকেই। বছর শেষেও নানা সমালোচনা অব্যাহত ছিল। বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার পর বইয়ে বানান ভুল ও বাক্যে অসংগতি নিয়ে তৈরি হয় বিতর্ক। বছরের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে কঠোর সমালোচনা। এ ছাড়া হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে প্রগতিশীল লেখকদের ১৪টি লেখা বিভিন্ন শ্রেণির বই থেকে বাদ দেওয়া হয়। সবশেষে ‘সহনীয় মাত্রায় ঘুষ’ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তোপের মুখে পড়েন শিক্ষামন্ত্রী। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার ফলে বিপর্যয় ও জালিয়াতি কায়দায় ভর্তি, উচ্চশিক্ষার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জবাবদিহির বাইরে থাকা, কোচিংসহ শিক্ষা বাণিজ্য বন্ধ করতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে না পারার বিষয়গুলো বছর জুড়েই আলোচনা ছিল। এদিকে, শিক্ষা প্রশ্নে কিছু কিছু বিষয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ থাকলেও সেই অর্জন চাপা পড়ে যায় উল্লিখিত বিতর্কের নিচে।
ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোতে মাধ্যমিক পর্যায়ের ১২টি পাঠ্যবই সহজীকরণ হয়। মাদ্রাসার বিভিন্ন শ্রেণির ৩৫টি বই থেকে ধর্মীয় উসকানিমূলক লেখা বাদ দেওয়া হয়। নতুন করে মুদ্রিত মাদ্রাসার বই পর্যবেক্ষণের জন্য প্রথমবারের মতো বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদ ঠেকাতে চলমান বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে আরো জোরদার করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ঢাকার লেকহেড গ্রামার স্কুল বন্ধ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ওপর নজরদারি বাড়ানো, বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন ও শিক্ষকদের জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। বৈশাখী বোনাস পান বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার এমপিওভুক্ত শিক্ষক এবং কর্মচারীরা। প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্যের স্পোর্টস ডিগ্রি চালু করে বিএসি ইন্টারন্যাশনাল স্টাডি সেন্টার।
বিদায়ী বছরজুড়ে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস ছিল এসব বিতর্কের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে সরকার এ বছরও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। কয়েকটি আইন করলেও যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া, এসএসসি ও এইচসির ফল-বিপর্যয়, পাঠ্যবই ছাপানোয় অনিয়ম, শিক্ষক সংকট, শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগ দিতে না পারা ও বিভিন্ন দাবি আদায়ে শিক্ষকদের আন্দোলন শিক্ষা খাতে বিভিন্ন অস্থিরতার জন্ম দেয়। বহুল কাক্সিক্ষত শিক্ষা আইন প্রণয়ন করতে পারেনি সরকার। শিক্ষকদের সংগঠনগুলো দাবি আদায়ে মাঠে নামলেও ‘প্রতিশ্রুতি’ ছাড়া তেমন কিছু মেলেনি।
কোচিং বাণিজ্য ও দুর্নীতি ঠেকাতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গত বছর তৎপর হওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক ও আশাসূচক আলোচনার জন্ম দেয়। বছরের পর বছর ধরে একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোচিং ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের অভিযোগে চলতি বছর রাজধানীর ৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৬১৯ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে দুদক। তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো উদ্যোগ ছিল না।
শিক্ষা খাতে নৈরাজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস, নোট বা গাইড ও কোচিং বাণিজ্য, জাল সনদে চাকরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণে অনিয়ম, এমপিওভুক্তি, প্রকল্পের টাকা হরিলুট, নিয়োগ ও বদলি বন্ধে বছরের শেষদিকে দুদক ৩৯ দফা সুপারিশ সংশ্নিষ্ট দফতরগুলোয় পাঠায়। সুপারিশ বাস্তবায়নে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ নির্দেশ দেন। এ বছর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ) ৩৬ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অনলাইন গণশুনানির আওতায় আনে। শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক অর্জন ও ইতিবাচক উদ্যোগ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে অনেকটা ম্লান হয়ে যায়। কোনো কোনো অর্জন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় সমালোচনায় ছিল বেসরকারি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর তদন্তে উঠে আসে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতা। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমান। রাজধানীর শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত সাত কলেজের পরীক্ষার সূচিসহ সাত দফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি চলাকালে পুলিশের টিয়ার গ্যাস শেলের আঘাতে দৃষ্টিশক্তি হারান সিদ্দিক। পরে কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার সূচি ঘোষণা করলেও চোখের আলো ফিরে পাননি সিদ্দিক।
ভয়াবহ সমস্যা হয়ে দেখা দেয় প্রশ্ন ফাঁস। ভর্তি পরীক্ষা, পাবলিক পরীক্ষা, নিয়োগ পরীক্ষা, এমনকি খুদে সোনামণিদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নও এবার ফাঁস হয়। ফাঁসের মূল উৎস চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ ও প্রশাসন। বিজি প্রেস থেকে প্রশ্ন ফাঁসের সন্দেহ করা হলেও সেখান থেকেই যে এমন ঘটনা ঘটছে, তা-ও পুলিশ নিশ্চিত হতে পারেনি। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে জালিয়াতি চক্র বিভিন্ন কায়দায় প্রশ্ন ফাঁস করলেও প্রশাসন মূল হোতাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে পারেনি। পুলিশি অভিযানে এ বছর আটক হন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ৭১ জন। কিছু ঘটনার তদন্ত কমিটি হলেও অধরাই ছিল ফাঁসের আসল রহস্য।
এদিকে, ঢাবির উপাচার্য নিয়োগকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের দুই অংশের হাতাহাতির বিষয়টিও নেতিবাচক আলোচনার জন্ম দেয়। আরো কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অনিয়ম সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে। এসএসসি ও এইচএসসিতে ফল বিপর্যয়ও ছিল আলোচনায়। এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গত দশ বছরের মধ্যে এবার পাসের হার ছিল সবচেয়ে কম। প্রগতিশীল লেখকদের ১৪টি লেখা বিভিন্ন শ্রেণির বই থেকে বাদ দেওয়া হয়। গত ১৪ জানুয়ারি গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে বইয়ে পরিবর্তনের জন্য সরকারকে ‘ধন্যবাদ’ জানায় হেফাজত। এর আগে ২০১৬ সালের ৮ এপ্রিল পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ‘মুসলমানের সন্তানদের নাস্তিক্যবাদ ও হিন্দুতত্ত্বের বিষয়ে পড়ানোর’ অভিযোগ তোলে সংগঠনটি। প্রাথমিক স্তরের বইয়ের ভুল সংশোধনে শুদ্ধিপত্র দেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির ভীতি দূর করতে চলতি বছরও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কার্যকর উদ্যোগ ছিল না। এ পদ্ধতিতে পড়ানোর মতো দক্ষ শিক্ষকের সংকট প্রকট ছিল। বেশির ভাগ শিক্ষক এখনো প্রশিক্ষণের বাইরে।
জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার ঘোষণার বাস্তবায়নে এ বছরে তেমন অগ্রগতি নেই। সেরা শিক্ষাবিদদের নিয়ে গঠিত জাতীয় শিক্ষানীতি কমিটি ড. কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের আলোকে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার কথা বলে। গত বছরের ১৮ মে শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত সভায় শিক্ষামন্ত্রী ও গণশিক্ষামন্ত্রী প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করে তা গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্তের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন। বিদায়ী বছরে অর্জনও অনেক। ২০৩০ সালের মধ্যে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে নতুনভাবে নয় দফা নির্দেশ জারি করে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন দাওরায়ে হাদিস সনদ ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি মাস্টার্স ডিগ্রি সমমান মর্যাদা পায়। ট্রেজারি থেকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আনা-নেওয়ার সময় স্বচ্ছ কাচের গাড়ি ব্যবহার আর ‘ক্যাডেট’ ও ‘ইন্টারন্যাশনাল’ নাম জুড়ে দিয়ে কোনো মাদরাসা পরিচালনা করা যাবে না বলে নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। খুদে শিক্ষার্থীদের ব্যাগসহ বই-খাতার ওজন দেহের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি হবে না বলে চলতি বছর প্রজ্ঞাপন জারি করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদজশর। জাতীয় শিক্ষা কাউন্সিল আইন-২০১৭-এর খসড়াও এনটিইসির সভায় চূড়ান্ত হয়। মন্ত্রণালয় এক আদেশে ১১তম শিক্ষা বোর্ড হিসেবে ময়মনসিংহের নাম ঘোষণা করে। ঢাবিতে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সব বিষয়ে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়। বেসরকারি ১২টি মডেল স্কুল ও কলেজ সরকারীকরণ হয়। বছরের শুরুতে বর্ণিল আয়োজনে উদ্যাপিত হয় জাতীয় পাঠ্যপুস্তক উৎসব। শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৫টি বই দেয় সরকার।