মৃৎশিল্প মানুষের উদ্ভাবিত প্রারম্ভিক শিল্পকলার একটি। বাংলাদেশের লোকজ কারুকাজে মৃৎশিল্পের কারিগরদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। মাটির তৈরি নানারকম বাহারি নজরকাড়া তৈজসপত্র আমাদের নান্দনিক জীবন ও সাংস্কৃতিকে করেছে আরো বিকশিত। আবহমান বাংলার লোকশিল্পের বিকাশ ঘটে প্রধানত মৃৎশিল্পের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের মাধ্যমে। আনুমানিক দশ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে প্রথম মৃৎশিল্পের আবির্ভাব ঘটে। তারপর মিসরে কুমারের চাকা আবিষ্কারের কথা জানা গেলেও কুম্ভকারের আদিনিবাস পৃথিবীর কোনো অঞ্চলে ছিল কি না তা এখনো জানা যায়নি। আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে বাংলাদেশে এক বিশেষ শিল্প হিসেবে বিকাশ লাভ করে মৃৎশিল্প।
মৃৎশিল্পের জন্য যে কাদামাটি ব্যবহার করা হয় তা আলাদা ধরনের। নদীর অববাহিকাতেই এই মাটি পাওয়া যাওয়া। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গাতে কয়েক ফুট মাটি খনন করলে এই মাটির সন্ধান মেলে। তবে প্রথম খননের স্তরের মাটি কালচে হলেও যত গভীরে যাওয়া যায় মাটির রং পীত ও ধূসর বর্ণের হয়। প্রথমত, মাটি সংগ্রহের জন্য কোদাল, খন্তা ও শাবলের প্রয়োজন হয়। মাটি সংগ্রহ করে মাটি খোলায় চার থেকে পাঁচ মাস মাটি সংগ্রহ করে রাখা হয়। এই পদ্ধতিকে ‘জাগ’ বলে। জাগ দেওয়া মাটিকে পা দিয়ে মাড়িয়ে নরম করে নেওয়া হয় যাকে মৃৎশিল্পের ভাষায় ‘ছানা’ বলা হয়। মাটি অল্প অল্প করে ছেনার মাধ্যমে অথবা সব মাটি একসঙ্গে করে কোদালের সাহায্যে চাক করে বড় ‘চাপ’ বানানো হয়। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় মাটিচাপা আর বৃহৎ আকৃতির মাটির এই স্তূপকে বলা হয় ‘চাপ’। তাছাড়া আরো একটি প্রক্রিয়া রয়েছে যে পদ্ধতিতে মাটি ছেনা, চাপা কোনোটিরই দরকার হয় না। সংরক্ষিত মাটিগুলোকে শক্ত করতে হবে রোদে শুকিয়ে। শক্ত মাটি আবার গুঁড়ো করা হয়।
তারপর সিমেন্ট দিয়ে তৈরি চৌবাচ্চায় পানি দিয়ে সেই গুঁড়োগুলো সেখানে সিক্ত করতে হবে। সিক্ত গুঁড়োগুলো কাঠির সাহায্যে নেড়ে পানির সঙ্গে মিশিয়ে তরল করতে হবে। দুই-তিন দিন এভাবে রাখার পর সব মাটি যদি ভালো মতো পানির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে থাকে তাহলে স্বাভাবিকভাবে পানি মাটির ওপর স্বচ্ছ হয়ে উঠবে। এবার পাত্রের সাহায্যে স্বচ্ছ পানি ধীরে ধীরে তুলে ফেলতে হবে। পানির পরিমাণ হ্রাস পেলে আবারও অপেক্ষা করতে হবে। এমন করে পানির শেষবিন্দু পর্যন্ত স্পঞ্জের সাহায্যে তুলে নিতে হবে। বড় একটি প্লাস্টিকের চাদর বিছিয়ে চারপাশে ইট-বাঁশ দিয়ে কোলের মতো করে তাতে এ চৌবাচ্চার কোমল মাটি পাত্রের সাহায্যে তুলে বিছিয়ে দিতে হবে। এভাবে থাকবে প্রায় একপক্ষ কাল। এরপর কোমল মাটি উপযুক্ত মনে হলে তা বড় বড় গোলাকৃতি করে কাপড়ে পেঁচিয়ে এমনভাবে রাখতে হবে, যাতে বাতাসে কঠিন হয়ে না যায়। তৈরি মাটি শুকিয়ে গেলে আগের রূপ দেওয়া কষ্টকর বলেই তা সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়। মাটি তৈরির এই তিনটি প্রক্রিয়ার পর তা মাটির জিনিস তৈরির উপযুক্ত হয়। জিনিস তৈরির সমপরিমাণ মাটি গোল করে ‘বুটি’ তৈরি করা হয়। তারপর মাটি পাত্র তৈরির জন্য প্রস্তুত হয়। এই মাটির গুটি যদি চাকে (হুইল) বসিয়ে করার জন্য তৈরি হয়, তাহলে তাকে বোওলা বলা হয়। স্তম্ভাকৃতির এই বোওলার উপরিভাগ কিছুটা উঁচু আর নিচের অংশ চ্যাপ্টা থাকে। কাজের সুবিধার্থেই সরু থেকে মোটা অংশের ব্যবহার হয়ে থাকে।
কুমিল্লা জেলার ইতিহাসে শিল্পকলার ঐতিহ্য অত্যন্ত গৌরবের এবং প্রশংসার। কালোত্তীর্ণ শিল্পকর্মের মধ্যে এ জেলার লালমাই-ময়নামতির পোড়া মাটির ফলকগুলো উল্লেখযোগ্য। এ পোড়া মাটির ফলক কুমিল্লা জেলার মৃৎশিল্পীদের অসামান্য নৈপুণ্যের স্বাক্ষর বহন করছে। তাছাড়া প্রত্নতত্ত্ব হিসেবে খননকালে লালমাই-ময়নামতি অঞ্চলে অনেক মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। কুমিল্লার ময়নামতি বিহারে ঐতিহ্যমন্ডিত, সুপ্রাচীন মৃৎশিল্পের ও পোড়ামাটির কর্মের উৎকৃষ্ট নিদর্শন রয়েছে। বাংলা মৃৎশিল্পের ও পোড়ামাটির কাজ যে একসময় চরম উৎকর্ষ ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল তা বিভিন্ন বিহার, স্তূপ, ফলকে উৎকীর্ণ প্রতিকৃতি চিত্র, মূর্তিখোদিত চিত্র, পান্ডুলিপি চিত্র এবং বিভিন্ন চিত্রিত হাঁড়ি-পাতিল, কলস ইত্যাদি থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। আবার পোড়ামাটির শিল্পকর্মও মৃৎশিল্পের শাখা কর্ম। এ শিল্প অতি প্রাচীন। পৌরাণিক ও নৃতাত্ত্বিক, জাতিতাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক ঘটনাসমূহের দলিলচিত্র।
কুমিল্লা জেলার মৃৎশিল্প মূলত বিজয়পুরকেন্দ্রিক। বিজয়পুর এলাকা ঘিরে গড়ে উঠেছে যেন মৃৎশিল্পের নগরী। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার উত্তর-দক্ষিণ বিজয়পুর, দুর্গাপুর, বারপাড়া, টেগুরিয়াপাড়া এবং নোয়াপাড়াসহ আশপাশের আরো কিছু গ্রামের চার শতাধিক পরিবার ৪০ বছরেরও অধিক সময় ধরে মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে বাজারজাতের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। জেলার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে সুবিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে মিহিদানার ন্যায় এক ধরনের সাদা কাদামাটি। এ সাদা কাদামাটিতে তৈরি করা হচ্ছে হাঁড়ি, পাতিল, বাটি, বদনা, মটকা, প্রদীপ, ছাইদানি, গ্লাস, সানকি, ঘড়া, কল্কি, গামলা, জলাবিড়া, জটধুসি, জলকান্দা, চুনপাত্র, সরাই, দুধের হাঁড়ি, ফুলদানি, মালসা, থালা, পানের বাটা, সন্ন্যাসীর গাড়–, খেলনা, কলস, মুবঘট, লক্ষ্মীঘট, আয়োঘট, পুজারঘট, দোয়াত বৈয়াম, দুধ সানার পত্র, লক্ষ্মীসরা, মটকা, কাজলবাটি নাদা, তবলার বায়া, মৃদংগ নাল, পাখোয়াজের মাটির খোল, দইছোবাসহ অসংখ্য রকমের দৃষ্টিনন্দন জিনিসপত্র। বিজয়পুরের মৃৎশিল্পীদের তৈরি নান্দনিক ও রুচিসম্পন্ন পোর্ট্রেট ঘর সাজানোর আধুনিক ধারার কারুকার্যখচিত সরঞ্জামাদি বিপুল সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া এগুলো ইউরোপ ও আমেরিকায়ও রফতানি হচ্ছে।
রুদ্রপাল সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি রতন চন্দ্র পালের মতে, ‘কুমিল্লা জেলার কুমাররা চাক ঘুরিয়ে মাটিকে দিচ্ছে শিল্পের রূপ। মাটির এক টুকরো পিন্ড থেকে তৈরি করে মৃৎপাত্র। সেই পাত্রে আঙুলের সুনিপুণ চাপ দিয়ে নকশা কেটে নানা রকম দৃষ্টি মনোহর কারুকাজ করে। ঐতিহ্যবাহী এ পেশাটিকে মানসš§তভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে তারা। পেশাটির সঙ্গে রক্তের সর্ম্পক তাই ছাড়তে পারছে না।’
রেজিস্ট্রেশনভুক্ত একমাত্র এই সমবায় সমিতির জনক বার্ড প্রতিষ্ঠাতা ড. আখতার হামিদ খান। কুমিল্লা-চাঁদপুর মহাসড়কের পশ্চিম পাশে ১৯৬১ সালে রুদ্রপালের ১৫ সদস্য নিয়ে মৃৎশিল্পের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে তিনি মাত্র ১৫০ টাকা আমানত সংগ্রহ করে সমিতির কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৬২ সালে বিজয়পুর তথা কুমিল্লার মৃৎশিল্পীদের একমাত্র প্রতিনিধিমূলক সংগঠন রুদ্রপাল সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করা হয়। রুদ্রপাল বংশের নামকরণে সমিতিটি গঠন করা হয়। সেই সময় কুমিল্লায় মৃৎশিল্পের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৬৪৪টি। মৃৎশিল্পে অভিজ্ঞতা ও উন্নতির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ, শেয়ার ও আমানত বৃদ্ধির মাধ্যমে মূলধন গঠন, শিল্পজাত দ্রব্যের সুষ্ঠু রাজারজাতকরণ সর্বোপরি মৃৎশিল্পীদের বেকারত্বের সমস্যা দূরীকরণের লক্ষ্যে এ সমিতি গঠিত হয়।
বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি লিমিটেডে কাজ শেখে এমন ১৫ জন শেয়ার হোল্ডার নিয়ে সড়কের পাশের জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে মৃৎশিল্প কেন্দ্র। গত বছর আট লাখ টাকা পুঁজি খাটিয়ে আয় হয়েছে ১৪ লাখ টাকা। যার মধ্যে মুনাফা হয়েছে ছয় লাখ টাকার মতো। এলাকার হিন্দু মুসলমান মিলিয়ে প্রায় ৭০টি পরিবারের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেছে এই শিল্পের মাধ্যমে। বিজয়পুর রুদ্রপাল সমবায় সমিতি লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার শংকর চন্দ্র পাল জানান, সমবায় অধিদফতরের মাধ্যমে বাংলাদেশ সমবায়ের মৃৎশিল্প উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প থেকে কুমিল্লা বিজয়পুর মৃৎশিল্পের উন্নয়নের জন্য ২০০৯ সালে ২ কোটি ৫১ লাখ ৩৯ হাজার বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দকৃত টাকায় আধুনিক কারখানা, ট্রেনিং সেন্টার, হোস্টেল ভবন, প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় নির্মাণ ছাড়াও উপকরণের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর প্রথম ২০১০ সালের ১১ মার্চ থেকে শুরু হয়ে একই বছরের জুন পর্যন্ত পাক্ষিক ভিত্তিতে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এই সময়ে মোট ২২০ প্রশিক্ষণার্থী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
বর্তমানে বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি প্রায় সহস্রের ওপর ক্রোকারিজসহ শো-পিস সামগ্রী রফতানি করছে ইউরোপ ও জাপানে। বিজয়পুর গ্রামের মৃৎশিল্পীরা গড়ে তুলেছে মাটির ক্রোকারিজসহ শো-পিসের দৃষ্টিনন্দন সাম্রাজ্য। মৃৎশিল্পীদের মেধা আর শ্রমে তৈরি মাটির ক্রোকারিজসহ শো-পিস আজ রফতানি পণ্যের তালিকায়। কাদামাটিকে পুঁজি করে নিজেদের বংশ পরম্পরার এই শিল্পকে সগৌরবে টিকিয়ে রেখেছেন তারা। স্বল্প পুঁজিতে কারখানা প্রতিষ্ঠা করে অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী বিধবা স্বামী পরিত্যক্তা অনেক শ্রেণির এ কাজে শামিল হচ্ছে। খুঁজে নিচ্ছে নিজেদের বেঁচে থাকার স্বাচ্ছন্দ্য।
|