স্বর্ণ চোরাচালানী। অত্যন্ত চেনাজানা, পরিচিত একটি বাণিজ্যিক অপরাধ কর্মকান্ড। প্রতিনিয়ত প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কর্মটি করার কারণে বছরে সরকার হারাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। মাঝে মধ্যে বড় অভিযানে এই কারবারিদের গডফাদার থেকে যারা চোরাচালানির কাজে সরাসরি অংগ্রহণকারীরা ধরা পড়ে। পরবর্তীতে আইনের ফাকফোকরে আবার সেসবৃ চক্র বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে পুরোনো কাজে আরো নিপূণভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে। ছাড়া পেয়ে তাদের সাহস আরো বেড়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে এসব অপরাধী শুধু স্বর্ণ চোরাচালানীই নয়, যুক্ত হয় আরো নতুন নতুন চোরা কারবারে। স্বর্ণের দামের তারতম্যের সাথে এধরনের কর্মকান্ডের বিরাট ভূমিকা রয়েছে বলেও মনে করা হয়। আর যারা হরহামেশা এসব কাজ করে পার পেয়ে যায়। তাদের কাছে স্বর্ণের বাজার রমরমা মানেই সোনালী দিনের হাতছানি।
চোরাচালানীর উপর ইনভেস্টিগেশন ৩৬০ ডিগ্রি নামক টেলিভিশনের বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, এদেশের অন্যতম একটি বড় পাচারকারী সিন্ডিকেট বেশ ক’বছর আগে সাভারের ভাগুঢ্যা এলাকা থেকে র্যাব -১ এর হাতে ধরা পড়ে। মাইক্রোবাসে করে ৭কেজি ৯৯১ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের বার নিয়ে চার চোরাকারবারী অবৈধ পন্থায় বেনাপোল সিমান্তে পাচারের লক্ষ্যে রওয়ানা হয়েছিলো। এদের মধ্যে ছিলো তাপস মালাকার, তার স্ত্রী মন্টি মালাকার, দুলালচন্দ্র দাস এবং অন্য একজন। মামলা হয় সাভার থানায়। জানা গেছে, সাজাও হয়েছে এদের।
এর আগে পলি রাণী দাস নামে এক চোরাকারবারী হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা মুল্যের ৪ কেজি ৪৬০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের বার সহ বিমান বন্দর কাস্টমসের হাতে ধরা পড়ে। আটক হবার পর কাস্টম এ্যাক্ট ও স্বর্ণ চোরাচালান আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে উক্ত বন্দরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মোঃ আবু সাঈদ বাদী হয়ে বিমান বন্দর থানায় মামলা করেন। পলি রাণী দাসের নিজের বিবৃতি, সাক্ষি প্রমাণ ও রিমান্ডে জিজ্ঞাবাদের পর আদালতে অপরাধ প্রমাণিত হয়। জানা গেছে, পলি রাণী দাসের আট বছরের সাজা হলেও মাত্র আড়াই বছর জেল ভোগ করে জামিনে বেরিয়ে পড়েছে সে। মামলা, জেল তার কাছে মামুলি বিষয়। পলি রানী দাসের মত স্বর্ণ চোরাকারবারীদের নিয়ে রীতিমত এই সেক্টর আতঙ্কিত। তার বর্তমান অবস্থান করা এলাকায়ও নানা কর্মকান্ডে এলাকাবাসী অতিষ্ট বলে অভিযোগ উঠেছে। সাজা হবার ঘটনা সবার মনে স্বস্তিদায়ক। তবে আদালত এদের সাজা পূর্ণ বহাল রেখে পূর্ণ সাজার পর জেল থেকে বের হবার কঠোর নিয়ম চালু করলে এধরনের অপরাধ ধিরে ধিরে কমে আসবে বলে মনে করে বিজ্ঞ মহল।
দীর্ঘদিন এভাবে শতশত কোটি টাকার স্বর্ণের চালান ধরা পড়ে চলেছে। একজন ধরা পড়ে আরেকজন আবার সেই কাজে দাঁড়িয়ে যায়। বন্ধ হয় না এসব কারবার। শুধু তাই নয়, সাজা হবার পরও কিছুদিন জেলে থাকার পর জামিনে বেরিয়ে আসে কেউ কেউ। লোক চক্ষুর আড়ালে, গোপনে আবার শুরু হয় কারবার। প্যান্টের ভেতর, কম্বলের ভেতর, পেটের ভিতর, বিমানের টয়লেটে, যাত্রীর জুতোর ভেতর, মানিব্যাগে, লাগেজে, হ্যাঙ্গার গেটে, বের্ডি ব্রিজ প্রভৃতি উপায়ে স্বর্ণের বার চোরাচালান হয়ে আসছে হরহামেশা।
দেশের অন্যতম শীর্ষ পত্রিকায় প্রকাশ, প্রায় প্রতিদিনই পাচার হয়ে আসা সোনা ধরা পড়ছে সাধারণত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরে। কাস্টমস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছেন, যত সোনা ধরা পড়ছে, তার কয়েক গুণ বেশি সোনা পাচার হয়ে যাচ্ছে। তবে সময়ের সাথে পাচার কমবেশী হলেও তা পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না। সোনা চোরাচালানের মামলা তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চোরাচালানে জড়িত ২৬টি চক্রকে পুলিশ শনাক্ত করেছে। এসব চক্রের রয়েছে একাধিক নেতা, মানি এক্সচেঞ্জ ও হুন্ডি ব্যবসায়ী প্রভৃতি। তথ্য মতে, চোরাই স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিমানবন্দর কাস্টমস, শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ ও আর্মড পুলিশের কিছু অসাধু কর্মচারী ও কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। এর সাথে যুক্ত এরা সবাই বাংলাদেশি। তবে তাঁদের সঙ্গে দুবাই ও ভারতের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা জড়িত আছেন বলে জানা যায়। আর এসব চালান সাধারণত দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে আসে । বাংলাদেশি চক্রের সদস্যরা মূলত চোরাই সোনা প্রাপকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করেন। আবার অনেকে আছেন বেশি মুনাফার লোভে বিনিয়োগও করেন এসব কাজে। তবে এর আগে জড়িত থাকা সন্দেহে ভারতীয় নাগরিক গ্রেপ্তার হবার পর জানা গেছে, সেদেশের বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী অনেকেই এই পথে সোনা আনতে লগ্নি করেন।
একটি সূত্র থেকে জানা যায়, ভারতের বাজারে সোনার দাম বেশি থাকায় বাংলাদেশকে সোনা চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক চোরাকারবারীরা। তাদের সাথে আছেন বেশ কিছু অসাধু সোনা ব্যবসায়ীও। একটি সুত্র থেকে জানা যায়, শুধু ভারতে পাচারই নয়, রাজধানী ঢাকাসহ বেশ কিছু এলাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ী চোরাকারবারীদের কাছ থেকে স্বর্ণের বার সংগ্রহ করে থাকে। অন্যদিকে এসব চক্র দেশের অভ্যন্তরে স্বর্ণ পাচারের পর সড়কপথে প্রতিবেশি দেশে উচ্চমূল্যে স্বর্ণ পাচার করার সময় প্রায়ই আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে।