দেশজুড়ে চলছে রমরমা কোচিং বাণিজ্য। রাজধানীসহ দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা, এমনকি থানা শহরেও রয়েছে এর শাখা ও প্রশাখার বিস্তার। সারাদেশে বড় ও ছোট মিলিয়ে প্রায় দুই লাখ কোচিং সেন্টার রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকসহ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও অন্যান্য দলের নেতা এগুলোর সঙ্গে জড়িত। আইনের কোনো তোয়াক্কা না করে দেদারসে মুনাফা লুটছেন এসব শিক্ষাবণিক। প্রশাসনের নাকের ডগায়ও চলছে বাণিজ্য। প্রতিবছরে কোচিংয়ের নামে লেনদেন হচ্ছে ৪০ কোটি টাকা।
গণসাক্ষরতা অভিযানের একটি প্রতিবেদন মতে, দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যন্ত অন্তত সাড়ে পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী আছে। তাদের মধ্যে অন্তত চার কোটি ২৪ লাখ ছাত্রছাত্রী কোনো না কোনোভাবে মূল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে অর্থের বিনিময়ে কোচিং নিচ্ছেন। এ সংখ্যা প্রায় ৭৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। প্রতিবছর কোচিং সেন্টারগুলো থেকে বাণিজ্য হয় ৪০ কোটি টাকা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কয়েক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানেও টাকার পরিমাণের সত্যতা আছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছে বিভিন্ন সময় বক্তব্য দিয়েছেন। তবে অন্য হিসাবে দুই লাখ কোচিং সেন্টার থেকে বছরে বাণিজ্যের পরিমাণ আরো বেশি। কোচিং সেন্টারগুলোতে বছরে লেনদেন হয় ৫০ হাজার কোটি টাকা। দেশের মোট কোচিং সেন্টারের সঠিক হিসাব প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই।
দেশি ও বিদেশি গবেষণা সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে এ মুহূর্তে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫৯ শতাংশ ও সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত (এমপিওভুক্ত) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যয়ের ৭১ শতাংশই নির্বাহ করে পরিবার। এ অর্থের সবচেয়ে বড় অংশই ব্যয় হয় কোচিংয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৩ শতাংশ আর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আটকে আছে কোচিংয়ে।
বেসরকারি সংস্থা এডুকেশন ওয়াচের এক প্রতিবেদন মতে, পারিবারিক ব্যয়ে প্রাইভেট ও কোচিংয়ের ওপর নির্ভরতা শিক্ষা ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকট তৈরি করছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ৮৮ শতাংশ, বেসরকারির ক্ষেত্রে ৭৮ শতাংশ আর মাদরাসার ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ অভিভাবক ছেলেমেয়েদের জন্য প্রাইভেট ও কোচিংয়ের ব্যবস্থা করে থাকেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একশ্রেণির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে শিক্ষক, বিদ্যালয় ও কলেজ পরিচালনা কমিটির নেতাদের পকেটেও ঢুকছে এসব টাকা। শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব পর্যবেক্ষণেও বছরে বাণিজ্যের টাকার পরিমাণ প্রায় একই। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কয়েকটি দলের তদন্তেও কোচিং বাণিজ্যের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। দুদকের প্রতিবেদনের নিরিখে রাজধানীর নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তত সাড়ে ৬০০ শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষাব্যবস্থায় একের পর এক নতুন পদ্ধতি চালু, শ্রেণিকক্ষে যথাযথ পাঠ না পাওয়া, শিক্ষকদের জবাবদিহি না থাকা, মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব আর সরকারি অর্থের অপ্রতুলতার কারণে শিক্ষাব্যবস্থা কোচিংনির্ভর হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে কোচিং নিয়ন্ত্রণে ২০১২ সালের নীতিমালা কার্যকর না হওয়ায় বাণিজ্য অনেকটা অবাধে চলছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী প্রজন্ম মেধাহীন হয়ে যাবে। কোচিং ব্যবস্থায় শিক্ষা ব্যয়ের চাপ বাড়ছে পরিবারের ওপর। এর নেতিবাচক প্রভাব দেশের সব খাতে পড়বে বলে আশঙ্কা শিক্ষাবিদদের। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘শিক্ষকরা কোচিং বাণিজ্য করতে পারবেন না। কোনো নোট বা গাইডবই চলবে না। এগুলো বন্ধে আইন করা হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িত কেউই ছাড় পাবে না।’
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী এ প্রসঙ্গে প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘কোচিং বাণিজ্যের লাগাম টেনে ধরার জন্য অনেক আগে থেকে আমরা দাবি জানিয়ে আসছি। এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশনাও ছিল। এখন দুদকও বলছে, ঢাকার কয়েকটি শিক্ষকের কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকার কথা। শিক্ষকদের এ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়ানো শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত ছাড়া কিছুই নয়। কোচিংয়ের কারণে শিক্ষার মান পড়ছে। দিন দিন নিম্নমুখী হচ্ছে। তাই লাগাম টেনে ধরতে হবে।’
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য কাজী ফারুক আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, ‘শিক্ষাব্যবস্থাকে ধবংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কোচিং বাণিজ্য। কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা করলে হবে না, এটা কার্যকর করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে সরকার একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করলেই কোচিং বাণিজ্যের মতো অনৈতিক প্রতিযোগিতা বন্ধ হবে।’
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষা নিয়ে কারো ছিনিমিনি করার অধিকার নেই। এ ক্ষেত্রে আমাদের সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন। কেন শ্রেণিকক্ষের শিক্ষা কোচিং সেন্টারে চলে যাচ্ছে—আমরা এদিকটা ভালোভাবে খতিয়ে দেখছি। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারকে সুপারিশ করেছি।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, শিক্ষায় সরকারের নানামুখী উদ্যোগ ও অর্জন আছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য বছরের শুরুতে বিনামূল্যের বই, মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি-মেধাবৃত্তি, শিক্ষার ভালো পরিবেশের জন্য আধুনিক ভবন ও শিক্ষা উপকরণ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সরকারের এত উদ্যোগ ও এত টাকা ব্যয়ের পরও অভিভাবকদের আয়ের এক-তৃতীয়াংশ ব্যয় করতে হচ্ছে কোচিং বাণিজ্যের জন্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১২ সালের ২০ জুন কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই বছরের ২৫ জুন নীতিমালায় একটি সংশোধনী আনা হয়। এতে সব বিষয়ের জন্য বিদ্যালয়ভিত্তিক কোচিং ফি সর্বোচ্চ এক হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। নীতিমালা জারি থাকলেও তা বাস্তবে মানা হচ্ছে না। নীতিমালা জারির শুরুর দিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির কারণে কোচিং ও প্রাইভেট কিছুটা নিয়ন্ত্রণ হলেও কিছুদিন পর শিক্ষকরা আবারও আগের মতো কোচিং-প্রাইভেটে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
নীতিমালায় বলা আছে, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং ও প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। তবে তারা নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের অনুমতিসাপেক্ষে অন্য প্রতিষ্ঠানে দিনে সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে নিজ বাসায় পড়াতে পারবেন। বাস্তবে এ নীতিমালা কেউই মানছেন না। নীতিমালা মানতে বাধ্য করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও নজরদারি নেই। তবে মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শিক্ষকদের কোচিং করানো বন্ধ করতে কঠোর বিধান রেখে প্রণয়ণ করা হচ্ছে শিক্ষা আইন। এ আইন অমান্য করে কেউ কোচিং ব্যবসায় জড়িয়ে পড়লে তার এক বছরের জেল ও জরিমানা হবে। পাশাপাশি তিনি চাকরিও হারাবেন। কোচিং ব্যবসা, প্রাইভেট পড়ানো ও গাইডবই নিষিদ্ধ করে শিক্ষা আইনের খসড়া ইতোমধ্যে সাজানো হয়েছে। মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য খসড়াটি শিগগিরই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে।
তথ্যমতে, বছরের পর বছর ধরে এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থেকে কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের অভিযোগে রাজধানীর আটটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৯৭ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে দুদক। তাদের বিরুদ্ধে ‘কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২’ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি কোচিং বাণিজ্য বন্ধে সরকারকে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে বলে দুদক। এরআগে নভেম্বরের শুরুতেও ২৪টি সরকারি বিদ্যালয়ের ৫২২ জন শিক্ষককে একই কারণে বদলির সুপারিশ করে দুদক। এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে কঠোর উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
|