দেশের মাদক চোরাকারবারিদের কাছে এখন ছোট আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা যখন অভিযানে যান, তখন চোরাকারবারিরা তাদের লক্ষ করে গুলি চালায়। কিন্তু চোরাকারবারিদের প্রতিহত করতে পাল্টা কোনো ‘ব্যবস্থা’ নেই দেশের মাদক নির্মূলে নিয়োজিত একমাত্র প্রতিষ্ঠানটির। খালি হাতে অস্ত্রধারী মাদক চোরাকারবারিদের আটক না করেই ফিরে আসতে হচ্ছে।
কখনো কখনো পুলিশের সহায়তায় মাদকবিরোধী অভিযানে নামে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)। সেটাও সব সময় করা হয়ে ওঠে না। আর তাই এবার সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের মতো আগ্নেয়াস্ত্র চায় সরকারি এ সংস্থাটি। মাদকবিরোধী অভিযানে ঝুঁকি থেকে নিজেদের জীবন রক্ষা ও অভিযান সফল করার যুক্তি দেখিয়ে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি চায় ডিএনসি।
ডিএনসির কর্মকর্তারা বলছেন, সংস্থার সব স্তরের জনবল নিরস্ত্র থাকায় মাদক উদ্ধার ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে অনেক সময় হামলার মুখোমুখি হতে হয়। ফলে অভিযান থেকে অনেক সময় পিছিয়ে আসতে হয়। এমনো হয়েছে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে অস্ত্র থাকায় অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে সংস্থাটির সার্বিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি সুনামও নষ্ট হচ্ছে। ফলে প্রত্যেক স্তরে অস্ত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ডিএনসি সূত্র জানায়, অস্ত্রের বিষয়ে খসড়া নীতিমালা তৈরির জন্য একটি কমিটি গঠন করে ডিএনসি। সেই কমিটি ৯ পাতার একটি খসড়া নীতিমালাও তৈরি করেছে, যা যাচাই-বাছাই চলছে। শিগগিরই ওই নীতিমালার খসড়া পাঠানো হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন মিললে ডিএনসির নিজস্ব তহবিল থেকে অস্ত্র কিনে কর্মকর্তাদের কাছে সরবরাহ করা হবে।
জানা গেছে, সিপাহীদের জন্য শর্টগান বা চাইনিজ রাইফেল এবং অফিসারদের (পরিদর্শক) জন্য রিভলবার বা পিস্তল চেয়ে প্রস্তাব দিচ্ছে ডিএনসি। অতিরিক্ত পরিচালক থেকে মহাপরিচালক পর্যন্ত কর্মকর্তারা দেহরক্ষী পেয়ে থাকেন। তাদের কাছেও অস্ত্র থাকবে। খসড়া নীতিমালায় অস্ত্র কোথা থেকে কেনা হবে, এর ব্যবহার বা অপব্যবহার, ব্যবহারের পর করণীয়সহ বিষদ বিষয় থাকছে। যাতে অস্ত্রের অপব্যবহার না হয়। তা ছাড়া যে অস্ত্র তাদের দেওয়া হবে তা কোথায় রাখতে হবে, হারালে বা খোয়া গেলে করণীয় কী, এসব বিষয়ও থাকছে।
এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) তৌফিক আহমেদ বলেন, আমরা এখন খসড়া নীতিমালা প্রস্তুত করেছি। খসড়া নীতিমালার যাচাই-বাছাই চলছে। খসড়া চূড়ান্ত হলে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন এবং নানা প্রক্রিয়া শেষে চূড়ান্ত আদেশ পেলে তবেই অস্ত্র কেনার চেষ্টা করবে ডিএনসি। এখনো অনেক কাজ বাকি। তবে শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে নীতিমালার খসড়াটি পাঠানো হবে। তিনি আরো বলেন, ডিএনসির সিপাহী থেকে পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) পর্যন্ত সবাইকে পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য অস্ত্র দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সংস্থাটি আর নিধিরাম সর্দার হয়ে থাকতে চায় না। আশা করা হচ্ছে, এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্পূর্ণ সহযোগিতা মিলবে।
জানা গেছে, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে জাতীয় এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাটির মাদকবিরোধী কার্যক্রম অনেকটা স্থবির। এর মধ্যে কয়েক মাস আগে ডিএনসির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সংস্থাটিকে ঢেলে সাজানো হবে বলে ঘোষণা দেন। তারই অংশ হিসেবে সংস্থাটির মহাপরিচালক পদে পরিবর্তন আনা হয়। এরপর অতিরিক্ত সচিব জামাল উদ্দিন আহমেদকে সংস্থাটির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
জানা গেছে, নতুন মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ যোগ দেওয়ার পর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি ১৫ দিনের কর্মকান্ড তদারকি করছেন। কাজের গতি বাড়াতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উৎসাহ ও তিরস্কার কিংবা প্রয়োজনে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হচ্ছে। গত ২৩ আগস্ট ঢাকা মেট্রো অঞ্চলসহ ২৭ জেলার কর্মকর্তাদের মাদক অভিযানে ব্যর্থতার কারণে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে।
ডিএনসি সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে সংস্থাটিতে জনবল সংকট রয়েছে। এ সংকট সমাধানেরও উদ্যোগে নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যমান জনবল কাঠামোতে প্রায় অর্ধেকের বেশি পদই শূন্য। ফলে সংস্থাটির স্বাভাবিক কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে। ডিএনসির জেলা পর্যায়ে একজন পরিদর্শক, একজন উপপরিদর্শক এবং তিনজন সিপাহী দায়িত্ব পালন করে থাকেন। পাঁচজন দিয়ে পুরো জেলায় মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়। সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, মাত্র পাঁচজন মানুষের পক্ষে পুরো জেলার দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব ব্যাপার। তারা নতুন জনবল নিয়োগের পক্ষে মত দেন।
তবে সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। বাড়ছে প্রতিষ্ঠানটির জনবল। ডিএনসি থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া মাদক ব্যবসায়ীদের ধরতে ও মাদকের অবাধ চালান বন্ধ করতে পুলিশ-র্যাব-বিজিবিসহ অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা বিনিময়ের উদ্যোগও নিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর।
ডিএনসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সারা দেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের জনবল ১ হাজার ৭০৫ জন। এর মধ্যে ৯৫৩টি পদে লোকবল রয়েছে। বাকিগুলো শূন্য। এত কম লোকবল নিয়ে সারা দেশ থেকে মাদক নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে মাদক নিয়ন্ত্রণে গঠিত এ অধিদফতরকে। কিন্তু বর্তমানে অধিদফতরের পক্ষ থেকে লোকবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ৮ হাজার ৪০০ জন লোকবলের একটি প্রস্তাবনা তৈরির কাজ চলছে, যা শেষ পর্যায়ে। দুয়েক দিনের মধ্যেই এটি তৈরির কাজ শেষ হবে। এরপর আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রস্তাবনাটি পাঠানো হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
নতুন এ প্রস্তাবনায় একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালকের স্থানে চারজন, ৮ জন পরিচালকের স্থানে ১৬ জন পরিচালকের পদ তৈরিসহ প্রত্যেক বিভাগের দায়িত্বে একজন করে পরিচালকের পদ রাখার কথাও প্রস্তাবনায় বলা হচ্ছে। নতুন এ প্রস্তাবনা অনুযায়ী প্রত্যেক জেলায় গোয়েন্দা ইউনিট থাকবে। এ ছাড়া প্রতিটি জেলায় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র গঠনসহ রেলস্টেশন ও নৌবন্দরগুলোতে ডিএনসির ইউনিট গঠনের কথাও বলা হয়েছে প্রস্তাবনায়।
ডিএনসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সারাদেশে মাদক নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিফতর একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু দেশজুড়ে মাদকের এত বিস্তৃতি হয়েছে যে, সে তুলনায় এর লোকবল খুবই কম। সীমিত এ জনবল দিয়েই রাজধানীসহ সারাদেশে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চলছে। গত ১১ সেপ্টেম্বর তেজগাঁওয়ের প্রধান কার্যালয়ে র্যাব, পুলিশ, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা (ডিজিএফআই), কোস্টগার্ড, বিজিবি ও আনসার-ভিডিপির প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করে ডিএনসি। ওই বৈঠকে আটটি সংস্থার প্রতিনিধিরা আলোচনায় মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা বিনিময়ের বিষয়ে একমত হন। ওই সংস্থাগুলোর তৈরি তালিকার সমন্বয়ে একটি চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করে যৌথ তালিকা করারও সিদ্ধান্ত হয়। ইতোমধ্যে প্রতিটি সংস্থার কাছে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
|